সামষ্টিক অর্থনীতি বিবেচনায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার কথা উল্লেখ করে তারা বলছেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও গত ৪৪ বছরের পাটকলগুলো লোকসান দিয়েছে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার নিরিখে পিপিপির প্রস্তাবনা দিয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণার পর অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে না। বরং সুফল বয়ে আনবে। তবে তা নির্ভর করে সরকার পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর কী পদক্ষেপ নেয় তার ওপর। একই সঙ্গে পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে সরকার যদি আধুনিকায়ন করে পিপিপির মাধ্যমে দেয়, তাহলে আবার লোকসানে পড়বে, সরকারের টাকা আবার নষ্ট হবে।
তিনি বলেন, এই পাটকলগুলোকে সংস্কার করতে দুই তিন বছর লাগবে। তবে দ্রুত করতে হবে। নতুন করে ইপিজেড না করে এই পাটকলগুলোর স্থানে ইপিজেড করা যেতে পারে। এখানে অনেক জায়গা রয়েছে। পুরানো ভবন ভেঙে ফেলতে হবে, মেশিনগুলো বিক্রি করে দিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় লিজ দিতে হবে। বন্ধ পাটকলগুলোতে সরকারের থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। সরকার শুধু জমির মালিকানায় থাকবে আর বেসরকারি খাতে ৪০ থেকে ৫০ বছরের জন্য জমি লিজ দিয়ে দেবে। সরকার যদি এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করে বা আদমজী জুট মিল যেভাবে করেছে, সেভাবে যদি করে তাহলে যে ২৫ হাজার লোক বেকার হলেও তার চারগুণ বেশি লোকের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এখান থেকে তিন-চারশ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করা যাবে।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক বলেন, এ খাত থেকে সরকারকে লাভ করতে হলে বেসরকারি খাতে বা ব্যক্তি মালিকানায় দেওয়াই হলো একমাত্র উপায়। সরকারি খাতে বা পিপিপির মাধ্যমে শুরু করলে আবার একই অবস্থা হবে। আগেও আধুনিকায়ন করে কোনদিন লাভের মুখ দেখেনি। বেসরকারি খাতকে দিলে তারা অনেক ভালো পাটকল চালাতে পারবে। পুরানো পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে কোনো লাভ হবে না। শুধু টাকাটা জলে ফেলে দেওয়া হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের ফলে কৃষকের ক্ষতি হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, কাঁচা পাটের চাহিদা রয়েছে। রপ্তানির ব্যবস্থা করলেই কৃষকরা ভালো দাম পাবে। বরং তারা লাভোবান হবে। এখন সরকারকে শুধু বেসরকারিভাবে কাঁচাপাট রপ্তানির জন্য আইন তৈরি করে দিলেই হবে। বাকিটা বেসরকারি খাত ব্যবস্থা করে নেবে।
অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সামস্টিক অর্থনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রয়াত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। কারণ গত ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছর লোকসান হয়েছে। এতে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান। গতবছরও ৭৫০ কোটি টাকা লস হয়েছে। এ লোকসানের কারণগুলো অজানা নয়। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, পাট ক্রয়ে সিন্ডিকেটের প্রভাব, আধুনিকায়নে গাফিলতি, বাজারজাতকরণে যথাযথ উদ্যোগের অভাব ইত্যাদি। তবে অনেকে বলেছেন, ১২০০ কোটি টাকা লাগবে আধুনিকায় করতে। কিন্তু পুরানো ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন করা হলোও তেমন লাভ হতো না। তাই সামস্টিক অর্থনীতি বিবেচনায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। তবে সেটা নির্ভর করবে পিপিপির শর্তগুলো কেমন হবে তার ওপর।
তিনি বলেন, সরকারকে আসলে ব্যবসার ভূমিকায় থাকা উচিৎ না। বর্তমান ব্যবস্থাপনা দিয়ে আধুনিকায়ন করা হলে কোনো উপকার হতো বলে আমি মনে করি না। একই সঙ্গে পিপিপির যে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে সেটা সফল হতে পারে যদি সুস্পষ্ট নিয়ম নীতি থাকে। যা এখন পর্যন্ত আমরা দেখতে পাইনি। এজন্য একটি টাক্সর্ফোস করে বা একটি কমিটি করে পিপিপির ধরনটা কেমন হবে সেটা আগে নির্ধারণ করতে হবে।
ড. নাজনীন বলেন, এই পাটকলে যে পরিমাণ জমি আছে তা নিয়ে যাতে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা বেদখল না হয়ে যায় সেদিকে সরকারকে নজর রাখতে হবে। এজন্য ব্যক্তি মালিকানায় পাটকলসহ ইপিজেড ও অর্থনৈতিক অঞ্চল করা যেতে পারে। এ ধরনের পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত দ্রুত আসতে হবে। এছাড়া যেহেতু সরকার পিপিপির মাধ্যমে পাটগুলো দিতে চাচ্ছে তাই পিপিপির শর্তগুলো এমন হওয়া উচিত যাতে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হয়।
শ্রমিকদের নিয়ে তিনি বলেন, পাটকল শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়া হলো মন্দের ভালো। এই টাকাটা যাতে শ্রমিকরা কাজে লাগাতে পারে সেজন্য আগামী দুই বছর তাদের মনিটরিংয়ে রাখা উচিত। এজন্য আদমজী জুটমিল বন্ধ করার পর শ্রমিকদের জন্য যেটা করা হয়েছিল সে সিস্টেমে যেতে হবে। পাশাপাশি নতুন কারখানাগুলোতে এই সকল পুরাতন দক্ষ শ্রমিকদের কাজে নেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নতুন মালিকদের কিছু উৎসাহ বা প্রণোদনা দিলে তারা হয়তো কাজে নেবেন। তারাই তখন এই শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে নেবে।
এদিকে পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জেএসডি, ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) ও ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। মিল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে খুলনা ও যশোরের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের ফটকে সন্তানদের নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সদস্যরা।
শ্রমিকদের ‘শতভাগ’ পাওনা মিটিয়ে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার। এতে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসর দেওয়া হবে। তাদের জন্য থাকবে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি। ১৫ দিনের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কমিটি এসব পাওনা পরিশোধের একটি রূপরেখা তৈরি করে সরকারকে দেবে। সরকার সেই রূপরেখা অনুযায়ী পাটকল শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করবে। এর ফলে ২০১৫ সালের সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী প্রায় ২৫ হাজার পাটকল শ্রমিকের পাওনা এককালীন পরিশোধ করতে সরকারের ব্যয় হবে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা।
স্বাধীনতার পর দেশের সব পাটকল জাতীয়করণ করা হয়, যার ফলে ৭৮টি পাটকল নিয়ে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরে ৩৫টি পাটকল সাবেক মালিকদের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে ২৬টি পাটকল রয়েছে এবং এগুলোর মধ্যে একটি বাদে বাকিগুলো উৎপাদনে আছে। এসব পাটকলে ২৪ হাজার ৮৬৬ জন স্থায়ী শ্রমিকের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত ও দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক রয়েছে আরও প্রায় ২৬ হাজার।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২০
জিসিজি/এজে