শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টিতে ষষ্ঠ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী পর্যন্ত ৯৪৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যাদের পড়ালেখায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যয় নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. কাঞ্চন আলীর জমির উপর তার দুই ছেলে এস এম জুলফিকার হায়দার ও এস এম জুবায়ের হায়দার বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ২০১৩ সালে কাঞ্চন আলীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় কাঞ্চন শিকদার বিদ্যানিকেতন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিচালনা পর্ষদে থাকা কাঞ্চন আলী ও তার দুই ছেলে বিনামূল্যে প্রতিষ্ঠান দু’টিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা চালু করেন। নিজেরা ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি যুগিয়েছেন বেশ কয়েকজন পরিশ্রমী শিক্ষক।
মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন আলীর ছোট ছেলে ও বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বি এম কলেজর অধ্যক্ষ জুবায়ের হায়দার জানান, বাবা (কাঞ্চন আলী) দীর্ঘ ৩৬ বছর বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের চাকরি করেছেন। এখনও তিনি তাদের প্রতিষ্ঠিত দু’টি প্রতিষ্ঠানে বিনা পারিশ্রমিকে ইংরেজি পড়ান।
‘মূলত বাবার স্বপ্ন পূরণ করা এবং গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই বিদ্যালয় দু’টি প্রতিষ্ঠা করা। তবে বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বি এম কলেজ প্রতিষ্ঠার একটি লক্ষ্য ছিল গ্রাম পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। ’
জুবায়ের হায়দার বলেন, আমাদের ও আশপাশের গ্রামের মানুষ অনেক সহজ-সরল। যাদের সন্তানরা সহসাই উচ্চ শিক্ষিত যেমন হতে পারে না, সমাজের ভালো জায়গায় যেতে পারে না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আমরা বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করি। শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে এখানে যেমন কোনো টাকা নেওয়া হয় না, তেমনি তাদের মাসিক কোনো বেতনও নেই। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো এখানে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস করানো হয়। আর শিক্ষকদের নিয়মিত বেতনসহ অতিরিক্ত ক্লাসের টাকা প্রতিষ্ঠাতা ও দাতারই দিচ্ছেন। এছাড়া সরকার যেহেতু বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে খাতা ও কলম কেনা ছাড়া কোনো ব্যয় নেই।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে আমাদের পক্ষ থেকেই বিনামূল্যে ছেলে-মেয়েদের বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাক তৈরি করে দেওয়া হতো। পরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আমরা রোল কিনে এনে পোশাকের কাপড় দিয়ে দিচ্ছি, আর শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে বানিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতি শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে আমরা বিনামূল্যে বাইসাইকেল দিচ্ছি। যা ছেলে-মেয়ে উভয়ই পাচ্ছে। তবে অনেকে মেয়ে বাইসাইকেল নিতে না চাওয়ায় এবার থেকে তাদের স্কুল ব্যাগ দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া শুধুমাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে সেরা ২০ জনকে বাইসাইকেল দেওয়া হয়ে থাকে। এর কারণ হিসেবে অধ্যক্ষ জুবায়ের হায়দার বলেন, যেহেতু ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আমাদের কার্যক্রম শুরু তাই শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আগ্রহ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভালোবাসা বাড়াতে এ উদ্যোগ। এর বাইরে উভয় প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বোর্ড পরীক্ষার ফরম ফিলআপের টাকাও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, এর সবকিছুই সদইচ্ছার কারণে হয়েছে। যেমন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুসাঙ্গিক মাসে দেড় লাখ টাকা খরচ রয়েছে। যা সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠাতাদের পক্ষ থেকে বহন করা হয়।
জুবায়ের হায়দার বলেন, আমাদের দুই ভাইয়ের ঢাকায় একটি প্যাকেজিং কারখানা রয়েছে। যেখানকার আয় থেকে এ দেড়লাখ টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের জমি ও ভবনের পরিধি দিন দিন বাড়ানো হচ্ছে, তার ব্যয়ও আমরা নিজেরা বহন করছি। তবে জমির ক্ষেত্রে ক্রয়ের থেকে বদল করে নেওয়া হয়েছে বেশি। স্কুলের পাশে থাকা অন্যের জমি আমরা নিচ্ছি। তাদের আমরা অন্যত্র থেকে জমি দিয়ে দিচ্ছি।
আর এসব কিছুতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে শিক্ষার্থীরাও বেশ ভালো ফলাফল করছেন বলে দাবি শিক্ষকদের। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, অষ্টম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় কাঞ্চন শিকদার বিদ্যানিকেতন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণকারী শতভাগ পরীক্ষার্থী যেমন প্রতিবছর পাস করছে, তেমনি জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাটাও আশানুরূপ।
অপরদিকে এসএসসি ও এইচএসসির পরিসংখ্যানে বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ থেকে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের পাসের হার ৯৫-৯৮ শতাংশের মধ্যে থাকছে প্রতিবছর।
শিক্ষক মিহির কর্মকার জানান, ২০১৯ সালে এসএসসিতে অংশগ্রহণকারী ৯১ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৮ জন পাস করেছে এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩১ জন। অপরদিকে এইচএসসিতে অংশগ্রহণকারী ৭৩ জন পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৪ জন পাস করেছে, যারমধ্যে জিপিএ-৫ ছিল ২৭টি।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আধুনিক পাঠদানের লক্ষ্যে দু’টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিজিটাল ল্যাব রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে সুবিশাল খেলার মাঠ ও নানা উপসর্গ। এছাড়া প্রতিটি ক্লাসরুম সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। ফলে শিক্ষক থেকে শুরু করে কারো ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার, মুক্তা আক্তার, নয়ন সিকদার, আরিফুর রহমান, রুমানা জানান, আশপাশের বিদ্যালয়গুলো থেকে এখানে পড়ালেখা করার নিয়মটা আলাদা। শিক্ষকরা যেমন প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখছেন তেমনি বিপদে-আপদে গোটা বিদ্যালয় আমাদের পাশে থাকে। বিনামূল্যে স্কুলড্রেস, বাইসাইকেল দেওয়াসহ নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে এ বিদ্যালয়ে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে।
বাংলাদেশ: ০৯২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২০
এমএস/আরবি/