তবে তা কেবল ইতিহাসের পাঠকদের কাছেই। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য এটি একটি দর্শনীয় জায়গাই বটে।
বর্তমান হাজারদুয়ারি প্রাসাদ প্রাঙ্গণের মধ্যে যে কয়েকটি পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে তার মধ্যে ইমামবাড়া, একটি কামান ও টাওয়ার ঘড়ি উল্লেখযোগ্য। আর মূল প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক উপকরণ।
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ প্রাঙ্গণের উত্তরপাশেই রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বড় ইমামবাড়াটি। দোতলা এই ২০৭ মিটার দীর্ঘ। বলা হয়, প্রথমে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাই এটিকে কাঠ দ্বারা নির্মাণ করান। এরপর কেটে গেছে আরও একশো বছর। ১৮৪৬ সালে একবার এতে আগুন লেগে যায়। এতে সম্পুর্ণ ইমামবাড়াটি পুরে যায়। বাংলা তখন ব্রিটিশদের দখলে। মসনদে তাদেরই অধীনত নবাব হুমায়ুন ঝাঁর ছেলে নওয়াব নাজিম মনসুর আলী। ১৮৪৭ সালে মনসুর আলী ফেরাদুন ঝাঁ প্রায় সাত লাখ রুপি ব্যয়ে এই ইমামবাড়াটি তখন পুনর্নির্মাণ করেন।
মহররমের মাসের এক থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত ইমামবাড়াটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তখন উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিয়া সম্পদায়ের লোকজন এখানে আসেন। মহরম মাসের শেষ দিন সকাল বেলা ইমামবাড়া থেকে একটি শোভাযাত্রা বের হয়। এতে হাসান-হোসেনের নকল মরদেহ শবাধারে বহন করে নগ্নপদে বুক চাপড়ে হায় হাসান, হায় হোসেন বলে শোকার্ত হৃদয়ে কারবালা প্রান্তর পর্যন্ত তিন কিমি রাস্তা ৬-৭ ঘণ্টায় অতিক্রম করে যা অতি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যের জন্ম দেয়।
যদিও এই অনুষ্ঠানের নবাবি আমলের জৌলুস আজ আর নেই। মহরম মাসের প্রথম দশদিন এখানে জাঁকজমকপূর্ণ মেলা হয়।
ইমামবাড়া ও হাজারদুয়ারি প্রাসাদের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি মদিনা মসজিদ। এর আকার বেশ ছোট। আসলে এটি মসজিদের আকৃতি বিশিষ্ট একটি ছোট ভবন। এটি মূলত হযরত মুহম্মদ (সা.) মদীনার রওজা মোবারকের অনুরূপ একটি প্রতিকৃতি।
এটি সিরাজের সময়ের স্থাপত্যশিল্পের একমাত্র নিদর্শন। সিরাজ নিজে এই ‘মদিনা’র জন্য কারবালা থেকে পবিত্র মাটি মাথায় করে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। মায়ের প্রতিজ্ঞা পালনেই তিনি এটি করেছিলেন। সিরাজের মা আমিনা বেগম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তার পুত্র নবাব হলে মদিনার পবিত্র মাটি এনে বহুমূল্যবান রত্ন দ্বারা এর দরজা প্রস্তুত করবেন। তবে, এটি কথিত। এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
দরজার বেদির উত্তর থেকে দক্ষিণ চার হাত, প্রস্ত এক হাত ও গভীরতা দেড় হাত। শোনা যায়, মীরকাসিম নবাব হলে তিনি মুঙ্গেরে রাজধানী স্থাপন করেন। তখন এর ধনরত্ম তিনি মুঙ্গেরে নিয়ে যান। এর দরজাটি কেবল মহরমের সময় খুলে দেওয়া হয়।
হাজারদুয়ারি প্রাসাদের উত্তর দিকে মদিনার পাশেই রয়েছে একটি বিশাল কামানটি। এটিকে বাচ্চাওয়ালী কামান বা তোপ বলা হয়। নবাব হুমায়ূন ঝাঁর সময় এটি ভাগীরথী নদী থেকে উদ্ধার করা হয়।
১৬৪৭ সালে ঢাকার বিখ্যাত কর্মকার জনার্দন কর্মকার এটি তৈরি করেন। জাহান কোষা কামানও তিনিই তৈরি করেছেন। এর দৈর্ঘ ১৮ ফুট ও প্রস্থ ২২ ইঞ্চি। এর ওজন আনুমানিক সাত হাজার ৬শ ৫৭ কেজি। জাহান কোষা কামান ছিলো মুর্শিদকুলি খাঁর আর এটি হচ্ছে সুলতান ইলিয়াস্ শাহর৷ এ কামানটি দাগার জন্য ১৮ কেজি বারুদ লাগতো। কথিত রয়েছে, এই কামান একবারই শুধু দাগা হয়েছিল। এর তীব্র আওয়াজে তখন বহু গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত ঘটে। সেই কারণেই এর নাম দেওয়া হয় বাচ্চাওয়ালি তোপ। এই ঘটনায় নবাব অত্যন্ত ব্যথিত হন। এর পরে কামানটি আর ব্যবহার হয়নি।
এছাড়া এখানে রয়েছে একটি উঁচু টাওয়ার ঘড়ি যা এখন সচল নেই। আগে বিরাট শব্দ করে এটি সময় জানান দিতো। সেই সঙ্গে নবাব বা ইংরেজ শাসকরা এলে ঘণ্টাও বাজানো হতো।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৭ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০১৭
এসএনএস
আগের পর্ব পড়ুন:
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন
** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির
** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার
** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান
** ১৭তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
** ১৮তম পর্ব: ফুটি মসজিদ: নির্মাণের অপেক্ষায় ৩শ বছর
** ১৯তম পর্ব: রোশনিবাগে শুয়ে আছেন নবাব সুজাউদ্দিন
** ২০তম পর্ব: মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের প্রাসাদ
** ২১তম পর্ব: বৈচিত্র্যময় মুর্শিদাবাদের খাবার
** ২২তম পর্ব: গ্রামের পথে খোসবাগ থেকে রোশনিবাগ
** ২৩তম পর্ব: রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ