ইংরেজদের কাসিমবাজার কুঠি ও মতিঝিলের ঘসেটি বেগমের প্রাসাদেই বাংলার স্বাধীন নবাবকে হটিয়ে ইংরেজদের অধীনস্থ মীরজাফরকে মসনদে বসানোর ষড়যন্ত্র হয়। সে ষড়যন্ত্র সফলও হয়।
সেই মতিঝিল আজও রয়েছে, নেই শুধু সেদিনের সেই প্রাসাদ। দামী পাথরের প্রাসাদ আজ মাটির সঙ্গে মিশে একাকার। মতিঝিলের সেই ষড়যন্ত্র প্রাসাদ যেনো আজ লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে মাটির গভীরে।
মতিঝিল প্রাসাদের সেই জায়গাটিতেই বর্তমানে পলাশির ইতিহাস নিয়ে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শো হয়। একটি মঞ্চে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দর্শকদের জন্য এই শো হয়। যেখানে একদিন ষড়যন্ত্র হয়েছিল, সেখানেই আজ সত্য উদ্ঘাটিত। ঘসেটি আর মীরজাফর কী জানতেন, ষড়যন্ত্রের অপর নাম ঘসেটি আর বিশ্বাসঘাতকতার অপর নাম একদিন মীরজাফর হবে? মানুষ, প্রাসাদ, ষড়যন্ত্র কিছুই স্থায়ী নয়, থাকে শুধু সত্য ও ন্যায়।
মতিঝিলের বর্তমান আয়তন এক হাজার ৫০ বিঘা। এর আশপাশের অনেক জায়গাই আজ বেদখল হয়ে গেছে। মতিঝিল মূলত একটি বিশাল হ্রদ। এর মাঝখানে রয়েছে বিশাল ভূখণ্ড আর তিনদিকেই পানি। মাঝখানের এই ভূখণ্ডে বর্তমানে একটি পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্র করা হয়েছে। এটি মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় পার্ক।
২০১৫ সালের ০১ জুলাই পার্কটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এর আগে, এই বিশাল জায়গাটি পরিত্যক্তই পড়ে ছিলো। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করেন। মতিঝিল পার্কের বর্তমান নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রকৃতি তীর্থ’।
ঐতিহাসিক নমুনা বলতে এখানে রয়েছে একটি মসজিদ, সমাধিক্ষেত্র ও মতিঝিল হ্রদ। ঘসেটির প্রাসাদ আজ নিশ্চিহ্ন। তবে মীরমর্দনের কামানের একটি অংশবিশেষ এখানে রাখা হয়েছে। মূল কামানটি রয়েছে হাজার দুয়ারি প্রাসাদে।
বাংলার প্রধান তিনি নবাব- মুর্শিদকুলি খাঁ, আলীবর্দী খাঁ ও সিরাজ-উদ-দৌলার তিনটি ভাষ্কর্য রয়েছে এই পার্কে।
মতিঝিলের মূল ফটকটি আজও রয়েছে, তবে তা ভগ্নপ্রায়। পাশেই নতুন করে গেট তৈরি করা হয়েছে। কথিত রয়েছে, মতিঝিল থেকে একসময় খোশবাগ দেখা যেতো।
বর্তমানে মতিঝিল শুধু একটি পার্কই নয়, মুর্শিদাবাদের বড় বিনোদনকেন্দ্রও বটে। বিকাল থেকেই নাচ, গান আবৃত্তি, নাটকসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকে মতিঝিল।
বিশাল এই পার্কে রয়েছে একাধিক উন্মুক্ত মঞ্চ যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতেই থাকে। ২০ টাকার বিনিময়ে মতিঝিল পার্কে ঢুকতে হয়। তবে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’র জন্য আরও ২০ টাকা গুনতে হয়।
এখানে একাধিক বাংলো বাড়ি রয়েছে। রয়েছে বিশাল উচু টাওয়ার যেখান থেকে পুরো মতিঝিলতো বটেই মুর্শিদাবাদেরও অনেকটা দেখা যায়। অত্যন্ত আধুনিক ও দৃষ্টি নন্দন পার্কের মিউজিক্যাল লাইটগুলো অসাধারণ দৃশ্যের জন্ম দেয়।
মতিঝিল আজ বাংলা সংস্কৃতির প্রধান তীর্থক্ষেত্র। মতিঝিল যেনো একখণ্ড বাংলাদেশ।
ঘসেটি বেগমের প্রাসাদটি যেখানে ছিলো সেখানেই বর্তমানে একটি মঞ্চ বানিয়ে পলাশীর ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’ হয়। আজকের প্রজন্ম হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে এই মতিঝিল থেকেই।
একদিন যে প্রাসাদে বসে বাংলার বিরুদ্ধে, সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, তারই ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে এ প্রজন্ম জানছে সেই ইতিহাস। মাঝে কেটে গেছে ২শ ৬০ বছর। মহাকালের নিয়মে এ তেমন বেশিকিছু নয়, ইতিহাস তো ফিরে আসবেই হাজার বছর পরে হলেও।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৭
এসএনএস
আগের পর্ব পড়ুন:
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন
** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির
** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার
** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান
** ১৭তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
** ১৮তম পর্ব: ফুটি মসজিদ: নির্মাণের অপেক্ষায় ৩শ বছর
** ১৯তম পর্ব: রোশনিবাগে শুয়ে আছেন নবাব সুজাউদ্দিন
** ২০তম পর্ব: মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের প্রাসাদ
** ২১তম পর্ব: বৈচিত্র্যময় মুর্শিদাবাদের খাবার
** ২২তম পর্ব: গ্রামের পথে খোসবাগ থেকে রোশনিবাগ
** ২৩তম পর্ব: রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ
** ২৪তম পর্ব: বাচ্চাওয়ালি কামান ও ইমামবাড়া
** ২৫তম পর্ব: হাজার দুয়ারি প্রাসাদে শেকলবন্দি নবাব
** ২৬তম পর্ব: রহস্যে ঘেরা ঘসেটি বেগমের ধনভাণ্ডার
** ২৭তম পর্ব: ষড়যন্ত্রের আখড়া ঘসেটির প্রাসাদ