আলীবর্দীর সময়ে মাহতাব চাঁদ নামের এক বিশেষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি এই উপাধি লাভ করেন। ইতিহাসে তিনি জগৎশেঠ নামেই পরিচিত।
১৭৫৬ সালে আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার নবাব হন। নবাব তাকে ইংরেজদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এই সুযোগ জগৎশেঠকে আরও অর্থবিত্ত অর্জনের সুযোগ করে দেয়।
জগৎশেঠ বাংলার নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলান। মীরজাফরকে বাংলার নবাব বানিয়ে প্রকারান্তরে ইংরেজদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা লাভই ছিল তার লক্ষ্য। এ জন্য তিনি দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে সুবেদারির ফরমান লাভে মীর জাফরকে আর্থিক সাহায্যও করেন।
সিরাজকে বাংলার মসনদ থেকে সরানোর ব্যাপারে এই জগৎশেঠের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এজন্য তিনি বিপুল অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেন। সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মীরজাফরের পরেই আসে জগৎশেঠের নাম।
মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের ধনভাণ্ডারের কিছুটা নমুনা এখনও পাওয়া যায়। লালবাগের কাছেই জগৎশেঠের বাড়ি। জগৎশেঠের টাকশালটি আজ আর নেই। তবে তার কিছু ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে। জগৎশেঠ পরিবারের উত্তরাধিকারীরা আজও বেঁচে থাকায় জগৎশেঠের বর্তমান বাড়িটি বেশ ভালোভাবেই রক্ষাণাবেক্ষণ হয়। এটি বর্তমানে একটি মিউজিয়াম।
এখানে জগৎশেঠের আমলের অনেক জিনিসপত্রই সংগৃহীত আছে। জগৎশেঠ পরিবারের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ও আকারের বন্দুক, পিস্তল, তলোয়ার, মশাল, খড়গ, ঢাল, গণ্ডারের চামড়া, অমঙ্গল শঙ্ক, হাত কামান, শত শত শো পিছ, তৈজসপত্র, উল্কাপিণ্ড, হাতির দাঁতের পাশা, খেলার গুটি, প্লেট, শাইরুল কাশ্মির, ফটো প্লেট, বডি স্প্রে, দোয়াত, রেজার, বেনারশি শাড়ি, চাদোয়া, টুপি, স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের পোশাক ও শাড়ি, সোনার তৈরি পোশাক, কাশার থালায় কৃষ্ণ অবতারের ছবি, পারিবারিক পোশাক, মসলিন, খড়ম, রাজেশ্বরী, মেয়ের পালংক, টেলিফোন, টেস্টিং জার, নকশীকাঁথা, টাকশালে তৈরি মুদ্রাসহ আরও বহু কিছু।
জগৎশেঠ নবাব বা রাজা না হয়েও তার রাজ-জৌলুসের কমতি ছিল না। বিপুল ধনসম্পদ থাকায় বহুবার তার বাড়িতে আক্রমণ হয়। ফলে তার বাড়িতে দু’টি গুপ্ত গুহা বা পথ ছিল যার অংশ বিশেষ এখনও আছে। এই গুপ্ত পথ বহুদূর পর্যন্ত গিয়েছে। কথিত আছে, একটি পথ নিকটবর্তী ভাগীরথী নদীতে গিয়েছে, যেখানে আক্রমণ হলে তিনি পালিয়ে বাঁচতে পারেন। আবার এও কথিত আছে যে একটি পথ কিছুদূর গিয়ে দিক পরিবর্তন করে অন্য কোথাও গিয়েছে, যা আজও অজানা।
এছাড়া, একটি গুপ্ত পথ দুই কিলোমিটার দূরে কাঠগোলা প্রাসাদ ও বাগানে গিয়েছে। কাঠগোলা প্রাসাদের গুপ্ত গুহার সঙ্গে জগৎশেঠের বাড়ির গুপ্ত গুহার সংযোগ থাকা খুবই স্বাভাবিক। কারণ দুই প্রাসাদই ছিল সে সময়ের দুই সম্পদশালীর প্রাসাদ।
তবে গুপ্ত গুহাগুলো পুরোপুরি আজ আর নেই। বাড়ির কিছু অংশ রেখে বাকিটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই গুহা আজ মিউজিয়ামের অংশ। দু’টি গুপ্ত গুহাতেই পুরোনো দিনের অনেক স্মারক সংগ্রহে রাখা হয়েছে। জগৎশেঠের রাজকীয় পোশাক ও ব্যবহার্য সামগ্রী তার রাজকীয় জৌলুসেরই পরিচয় বহন করে।
এখানে আছে এক অদ্ভুত আয়না, যেখানে কিছুতেই নিজের মুখ দেখা যায় না। মুখ ছাড়া সব কিছুই দেখা যায়। এর রহস্যভেদ করা কঠিন। এরকম আয়না হাজার দুয়ারি প্রাসাদেও আছে। হয়তো রাজসভায় নিরাপত্তা ও ষড়যন্ত্রকারীদের মুখাবয়ব দেখার কাজেই এটি ব্যবহার হতো। এছাড়া, আছে বিখ্যাত বেলজিয়ামের আয়না।
একটি আংটির ভেতরে পুরো একটি মসলিন শাড়ি রাখার কথা শুনেছি। ঢাকাই এই মসলিনের একটি নমুনা দেখা গেলো জগৎশেঠের বাড়িতে। উল্লেখ্য, জগৎশেঠরা ঢাকায়ও ব্যবসা করতেন।
লর্ড ক্লাইভের একটি পোশাক আছে এখানে, যা ইংরেজদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠের আঁতাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। জগৎশেঠের টাকশালে তৈরি অনেক মুদ্রা আজও আছে।
বিষাক্ত খাবার পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ থালা এখানে রক্ষিত আছে।
ওই সময়ে ভারতবর্ষের সেরা রাজ-নর্তকী ছিল হীরা বাই। কথিত আছে, হীরা বাইয়ের উচ্চতা ছিল ৬ ফুট ২ ইঞ্চি আর ওজন ছিল মাত্র ৪২ কেজি। হীরা বাইয়ের একটি পেইন্টিং রয়েছে এখানে।
জগৎশেঠ পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত সোনা ও রূপার পোশাক রয়েছে মিউজিয়ামে। এখানে রয়েছে একটি প্রাচীন টেলিফোন সেট, যা দিয়ে জগৎশেঠ ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
পলাশীর সব বিশ্বাসঘাতকদেরই করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। জগৎশেঠও তার ব্যতিক্রম নন। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরাই জগৎেশঠের টাকশাল ও প্রাসাদ লুট করে। তাকে সর্বস্বান্ত করে। তার টাকশালও বন্ধ হয়ে যায়। একসময় শেঠ পরিবারকে সরকারি ভাতা দিয়ে দিন যাপন করতে হতো।
পরিণতি এখানেই শেষ নয়! সে সময়ের মুর্শিদাবাদের আরেক ডাকাত কাঠগোলা প্রাসাদের সিংজির সঙ্গে জগৎশেঠের ছিল দহরম-মহরম। জগৎশেঠের বাড়ির গুপ্ত গুহা দিয়ে সিংজির কাঠগোলা প্রাসাদে যাওয়া যেতো। সে গুপ্ত গুহা আজও আছে (তবে পরিত্যক্ত)। পলাশী যুদ্ধের পরে এই কাঠগোলা প্রাসাদেই ষড়যন্ত্রকারীরা যার যার পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য বৈঠক করেছিল। সে টেবিলটি কাঠগোলা প্রাসাদে আজও আছে। কিন্তু নিয়তির কী পরিহাস! কিছুদিন পরে এই কাঠগোলা প্রাসাদেই জগৎশেঠকে হত্যা করা হয়। ইংরেজরাই এ কাজ করে। সঙ্গে ছিল মীরজাফর চক্র। শুধু জগৎশেঠ একাই নন, সপরিবারে তাকে হত্যা করা হয় ওই কাঠগোলা প্রাসাদে। এভাবে ইতিহাসের বিশ্বাসঘাতকদের করুণ পরিণতি ভোগ করতেই হয়; কখনো ব্যক্তিকে আবার কখনো পুরো জাতিকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৭
এইচএ/
আগের পর্ব পড়ুন
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন
** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির
** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার
** ১৫তম পর্ব: কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ির বড় আয়োজন
** ১৬তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর জগৎজয়ী কামান
** ১৭তম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি
** ১৮তম পর্ব: ফুটি মসজিদ: নির্মাণের অপেক্ষায় ৩শ বছর
** ১৯তম পর্ব: রোশনিবাগে শুয়ে আছেন নবাব সুজাউদ্দিন
** ২০তম পর্ব: মুর্শিদাবাদের শেষ নবাবের প্রাসাদ
** ২১তম পর্ব: বৈচিত্র্যময় মুর্শিদাবাদের খাবার
** ২২তম পর্ব: গ্রামের পথে খোসবাগ থেকে রোশনিবাগ
** ২৩তম পর্ব: রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ
** ২৪তম পর্ব: বাচ্চাওয়ালি কামান ও ইমামবাড়া
** ২৫তম পর্ব: হাজার দুয়ারি প্রাসাদে শেকলবন্দি নবাব
** ২৬তম পর্ব: রহস্যে ঘেরা ঘসেটি বেগমের ধনভাণ্ডার
** ২৭তম পর্ব: ষড়যন্ত্রের আখড়া ঘসেটির প্রাসাদ
** ২৮তম পর্ব: মতিঝিল: ষড়যন্ত্রস্থলে আজ প্রকৃতি তীর্থ