বাগেরহাট থেকে: আদিকাল থেকে ভোলা নদী সুন্দরবন ও এর আশপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করছে। যদিও ক্ষীণ হতে হতে এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে নদীটি।
সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কাছে খানিকটা প্রশস্ত থাকলেও যতোই উজানে গেছে ততোই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণকায় হয়েছে নদীটি। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাজাপুর গ্রামের কাছে। দক্ষিণ রাজাপুরে প্রস্থ ৩০ মিটারের নিচে নেমে গেছে। আর উত্তর রাজাপুরে প্রস্থ পাঁচ মিটারেরও কম।
এখানে জনপদ ও সুন্দরবন মিশে একাকার। রাখালেরা মহিষের পাল নিয়ে অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছেন বনের মধ্যে। সারাদিন ঘাস খাইয়ে সন্ধ্যায় ফিরছেন গ্রামে। কখনও কখনও গরু-মহিষের পাল একাই নদী সাঁতরে ঘাস খাওয়ার জন্য চলে যাচ্ছে বনের ভেতরে। বাদ যাচ্ছে না ছাগলও।
রোজকার মতো রোববারও (১৮ ডিসেম্বর) সুন্দরবনের ধানসাগর স্টেশন কার্যালয়ে বনের মধ্যে গরু-ছাগল চরতে দেখা গেছে। এমনকি স্টেশন অফিস কম্পাউন্ডের মধ্যেই কতোগুলো গরু চরছিল। যে কাঠের ব্রিজ দিয়ে বন বিভাগের লোকজন লোকালয় থেকে বনের ভেতরে যান, সেই ব্রিজ দিয়েই গরু-ছাগল বনের ভেতরে যাওয়া আসা করছে।
খালি চোখে হয়তো কেউ এর ক্ষতির কোনো কারণ খুঁজে পান না। কিন্তু বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা ভয়ঙ্কর কিছুর শঙ্কা করছেন। তারা মনে করছেন, এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এ বিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাইদুর ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, দেখেন গৃহপালিত এসব প্রাণীর নেচার এক রকম আর বন্যপ্রাণীগুলোর সম্পূর্ণ আলাদা।
তিনি বলেন, গৃহপালিত প্রাণীর বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই থাকতে পারে। আমরা সাধারণত নানা ধরনের মেডিসিন ব্যবহার করি। মেডিসিন ব্যবহারের ফলে জীবাণুগুলোও তাদের চরিত্র বদলে ফেলছে। নানারকম জীবাণুবাহী গৃহপালিত প্রাণীর মাধ্যমে কোনো ভাইরাস যদি বন্য প্রাণীদের শরীরে প্রবেশ করে তাহলে কি ঘটতে পারে একবারও ভেবে দেখেছেন?
সাইদুর ইসলাম বলেন, ধরেন যদি কোনো কারণে বাঘ আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে রক্ষার জন্য কি কিছু করার থাকবে? কিছুই করার থাকবে না। কারণ গরু-মহিষ হাতের নাগালে থাকে, আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করানো যায়। কিন্তু বাঘ-হরিণ-বানরকে কীভাবে ওষুধ দেবেন। কোনো প্রাণী আক্রান্ত হলে হয়তো খোঁজই পাওয়া যাবে না।
প্রায় মরা নদী ভোলাকে জীবিত করার জন্য ২০০৪-০৫ অর্থবছরে খনন করা হয়েছে। খনন করে মাটি ফেলা হয়েছে সুন্দরবনের ভেতরের দিকে। এতে সুন্দরবনের সঙ্গে পুরোপুরি সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে নদীটি। আগে জোয়ারের সময় সুন্দরবনের সঙ্গে নদীটি মিশে একাকার হয়ে যেতো। কিন্তু একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে নদীটিকে শ্রীহীন করা হয়েছে।
নদীটির ক্ষীণকায় হওয়ার অন্যতম কারণ বেড়িবাঁধ। আগে জোয়ারের পানি বিভিন্ন খাল-বিলে প্রবেশ করতো। আর তাতে জোয়ারের পানির সঙ্গে আসা পলি খাল-বিলে চলে যেতো। এখন খাল-বিলে পানি প্রবেশের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় সব পলি আটকে থাকছে নদীতে। আর পলি পড়ে পড়ে একসময় নদীগুলো শিল্ড হয়ে যাচ্ছে। জেগে উঠছে চর। সেই চরে মানুষ স্থাপন করছে বসতি। এভাবে দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে নদী।
ধারসাগর স্টেশনে গরুর বিচরণ প্রসঙ্গে ওই স্টেশনের বোটম্যান সুন্দর আলী জানান অসহায়ত্বের কথা। তিনি দাবি করেন, অনেকবার বলেও লোকজনকে ঠেকানো যায় না। তারা জোর করেই গরু-ছাগল বনের মধ্যে নিয়ে যান। এতে যে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে সে কথা তিনিও স্বীকার করেন।
বন বিভাগের লোকজন মনে করেন, নদীটি বন ও জনপদের মধ্যে সেফগার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একদিকে যেমন বনকে রক্ষা করছে, একইসঙ্গে জনপদকেও নিরাপত্তা দিচ্ছে। নদী ডিঙিয়ে সহজে বন্যপ্রাণী জনপদে প্রবেশ করতে পারে না। বনের কোনো ভাইরাস জনপদকে স্পর্শ করতে পারে না। এই সেফগার্ডকে রক্ষা করা জরুরি। না হলে সুন্দরবনকে হারাতে হতে পারে।
আরও পড়ুন
**খেজুর রসের গন্ধে মাতাল!
**কুসংস্কারে ভরা দীঘি সম্ভাবনায় ঠাসা
**বাগেরহাট ডিসির কষ্ট ও বাস্তবতা
** চিত্রায় প্লেনের ছোঁয়া
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৬
এসআই/জেডএস/এসএনএস/এএ