স্থানীয় সময় বুধবার (২২ মার্চ) বিকেল পৌনে ৩টার দিকে লন্ডনে পার্লামেন্টের সভাস্থল ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেসের কাছে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে এ হামলার সূত্রপাত হয়। এটিকে ‘সন্ত্রাসী ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করছে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ।
পুলিশের বরাত দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, হামলাকারী প্রথমে ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজে পথচারীদের ওপর তার চার চাকার প্রাইভেট গাড়ি চালিয়ে দেয়। এরপর গাড়ি থেকে ছুটে গিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেসের সামনে দায়িত্ব পালনকারী ওই পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাত করে। তারপর সে পার্লামেন্টে এমপিদের প্রবেশের পথ দিয়ে ছুরি নিয়ে ভেতরে ছুটে যেতে চাইলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে দু’টি গুলি করেন। ওদিকে তার ছুরিকাঘাত ও গাড়ির চাপায় কাতরাতে থাকেন পুলিশ ও পিষ্ট হওয়া পথচারীরা। তবে কিছুক্ষণ পরই ঘটনাস্থলে মারা যান পুলিশ সদস্য। তৎক্ষণাৎ হামলাকারী এবং অন্যদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হলেও সেখানে হামলাকারীসহ তিনজনের মৃত্যুর খবর দেন চিকিৎসকরা।
নিহতদের মধ্যে ছুরিকাহত পুলিশ সদস্য ও হামলাকারী ছাড়া বাকি দু’জন পথচারী। এদের মধ্যে একজন নারী রয়েছেন। যে ২০ জন আহত হয়েছেন তাদের অনেকের অবস্থাও গুরুতর। আহতদের মধ্যে তিনজন ফরাসি শিক্ষার্থী রয়েছেন। রয়েছেন কয়েকজন কোরিয়ান ও রোমানিয়ানও। বাকিদের পরিচয় তৎক্ষণাৎ জানা যায়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, হামলাকারীর গাড়ির চাপায় আহত লোকজন ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে পড়ে কাঁতরাচ্ছিলো। তাদের কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
হামলার প্রথম দিককার চিত্র তুলে ধরে সংবাদমাধ্যম জানায়, প্রথমে চারটি গুলির বিকট শব্দ শুনতে পান পথচারীরা। তখন ৪০-৫০ জনের মতো মানুষ নানাদিকে ছোটাছুটি শুরু করে। পরে হামলার বিষয়টি বুঝতে পারে সবাই। তৎক্ষণাৎ সতর্কতা পেয়ে গাড়ি বহর নিয়ে পার্লামেন্ট ছেড়ে নিজের বাসভবন ডাউনিং স্ট্রিটে চলে যান প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। তারপর তার মুখপাত্র এক বিবৃতি দিয়ে জানায়, প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ আছেন, যদিও এ ঘটনায় ‘তার উপস্থিতি ছিল না’।
এদিকে, হামলার সময় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের অধিবেশন চলছিল। গুলির শব্দে এবং সতর্কতা পেয়ে অধিবেশন মুলতবি করা হয়। তখন পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পার্লামেন্টের সদস্যদের ভেতরে অবস্থান করতে বলা হয়। একইসঙ্গে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজসহ আশপাশের বাসিন্দাদেরও নিরাপদে অবস্থান করতে বলা হয়। বেশ কয়েকঘণ্টা এ নির্দেশ বলবৎ থাকে।
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী প্যাট ম্যাককোরম্যাক বলেন, আমি দেখলাম ওই লোকটি (হামলাকারী) অফিসারের (পুলিশ) পেছন থেকে মাথায় ও ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করলো এবং তারপর সে পার্লামেন্টের ভেতরে ঢুকতে দৌঁড়াতে থাকলো। খানিকবাদেই সে লুটিয়ে পড়লো (সম্ভবত গুলির পর)।
লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ এটাকে ‘সন্ত্রাসী ঘটনা’ বলে উল্লেখ করে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ এলাকাসহ পুরো লন্ডনে সতর্কতা জারি করেছে। তারা ঘটনাস্থলে এবং পার্লামেন্ট এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে জরুরি ‘কোবরা’ বৈঠক (সংকটকালে ডাকা সংক্ষিপ্ত বৈঠক) করেছেন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। তিনি হামলায় হতাহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে সংকট কাটিয়ে উঠতে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বৈঠকের পর ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্রিটিশ জনগণ ‘অসুস্থ ও ভ্রষ্টচারীদের হামলায়’ ভেঙে পড়বে না।
হামলায় একজনই জড়িত ছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলে দেন, ব্রিটেনজুড়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি মারাত্মক (সেভিয়ার) বলে যে সতর্কতা ছিল, তা অপরিবর্তিতিই থাকবে। তবে ব্রিটিশ জনগণ প্রতিদিনের মতোই তাদের বৃহস্পতিবার সকালটা শুরু করবে। কারণ ব্রিটিশরা সন্ত্রাসের হাতে তাদের ভাগ্য ছেড়ে দেবে না।
লন্ডনের মেয়র সাদিক খানও তার করপোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, লন্ডনের জনগণ সন্ত্রাসের কোনো চোখ রাঙানিকে ভয় পায় না। লন্ডন আগের মতোই এর বাসিন্দাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বলে প্রতীয়মান হবে।
হামলাকারীর পরিচয় কী বা কেন সে হামলা করেছিল সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে না পারলেও ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি মেইল বলেছে, ওই হামলাকারী মধ্যবয়স্ক এশিয়ান। পুলিশ মনে করছে, সে একলা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এ ঘটনায় যে অন্য কেউ জড়িত থাকতে পারে না, তাও জোর দিয়ে বলছে না তারা।
হামলার ঘটনার পর পার্লামেন্ট এলাকায় এমপিসহ সর্বস্তরের লোকদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হলেও এখন সবাইকে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ এলাকায় আটকে পড়া শিশুদেরও নিয়ে যেতে তাদের অভিভাবকদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, এ সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, রোমানিয়া, লুক্সেমবার্গ, ইসরায়েলসহ বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। তারা দুঃসময়ে যুক্তরাজ্যের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি কথা বলেছেন টেরিজা মে’র সঙ্গে। তিনি টেরিজাকে হামলার ঘটনায় নিজের শোকের কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৭/আপডেট ০০৩৫/আপডেট ০১৩৫ ঘণ্টা/০৪০৩ ঘণ্টা
এমএন/জেডএস/এইচএ