অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই গুয়ামের আদি অধিবাসীদের বলা হয় চামোরো। শান্তিপ্রিয় এই জাতি উপভোগ করে তাদের সহজ-সরল জীবন।
কিন্তু এক অদ্ভুত প্রকৃতি আর মানবসৃষ্ট বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে বয়ে চলছে গুয়ামবাসীর জীবন। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে গুয়ামের চামোরো জাতি সাক্ষী হয়ে আছে মানব-ইতিহাসের ভয়াবহ কিছু ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের।
প্রতিদিনই এখানকার অধিবাসীদের চোখে পড়ে পোশাকধারী সৈন্য, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার। নিয়মিত এখানে অনুষ্ঠিত হয় সামরিক মহড়া। বিভিন্ন সমরাস্ত্রের পরীক্ষা যেন এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে এই ছোট্ট গুয়াম দ্বীপে গড়ে তোলা হয়েছে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি। পূর্ব এশিয়ার খুব কাছে হওয়ায় সামরিক কৌশলগত কারণে এই দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রতিটি সময়ই গুয়াম দ্বীপকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। প্রথমে স্পেন এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে থাকা এই দ্বীপকে যুদ্ধে ‘বলির পাঁঠা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়।
এর প্রমাণ মেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে হামলার পর জাপানি সৈন্যরা দখল করে নেয় গুয়াম দ্বীপ। এর কিছুদিন আগেই অসহায় চামোরোদের বিপদের মাঝে রেখে গুয়াম থেকে অধিকাংশ মার্কিন সেনাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আর জাপানি সৈন্যদের অসহনীয় নির্যাতন নেমে আসে গুয়ামবাসীর ওপর। স্বার্থে ব্যবহার করলেও এমন অবস্থায় প্রায় আড়াই বছর হাত গুটিয়ে রাখে যুক্তরাষ্ট্র। জাপানিদের নির্যাতনে নিহত হয় এক হাজারেরও বেশি চামোরো।
একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির শঙ্কায় বিশ্ব রাজনীতিতে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া গুয়াম দ্বীপের নাগরিকেরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার হুমকি ও পালটা-হুমকি তাদের সেই শঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে নিদ্রাহীনতা পর্যন্ত। তাই গুয়ামের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সংবাদ ও টুইটারে উত্তর কোরিয়ারকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি আতঙ্কগ্রস্ত করছে গুয়ামবাসীকে।
গুয়ামের প্রায় সবার চোখে-মুখে এখন বিরাজ করছে রাজ্যের সংশয়। বিদেশ-বিভূঁইয়ের আত্মীয়-স্বজনেরা ফোনে জানাচ্ছে তাদের দুশ্চিন্তার কথা। মা তার সন্তানকে ফোন দিচ্ছে। বান্ধবী তার বান্ধবীকে। সবাই পরামর্শ দিচ্ছে খুব দ্রুত নিরাপদ কোনো স্থানে চলে যেতে। সেইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে নানা তর্ক-বিতর্ক।
গুয়ামের ওপর হামলা হলে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য দুই মিনিটের বেশি সময় পাবে না সেখানকার জনগণ। সবচেয়ে ভয়াবহতা নেমে আসবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হলে। তাই পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে অনেকে বিষক্রিয়া নিরোধক ওষুধ ও প্রতিরক্ষামূলক পোশাক হাতের কাছে রেখে দিয়েছে। কখন মৃত্যু এসে দরজায় কড়া নাড়বে, এই আশঙ্কায় ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছেন অনেকে।
গুয়ামের সামরিক ঘাঁটিতে কর্মরত মার্কিন সেনা সদস্যদের পরিবারেরও দুশ্চিন্তার কমতি নেই। কখন কী ঘটে যায়! কিন্তু তাদের তো যুক্তরাষ্ট্রে সরে যাওয়ার সুযোগ থাকবে, চামোরোদের কী হবে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো আবারও একই পরিণতি ঘটুক গুয়ামের ভাগ্যে, সেটা কেউ চায় না। কিন্তু যুদ্ধ বাঁধলে যে সবার আগে গুয়ামই আক্রান্ত হবে, সেটা সবারই জানা। পারমাণবিক যুদ্ধে বিশ্বের কারোরই জয় হয় না। পরাজয় হয় কেবল মানবতার, ক্ষয় হয় নিরীহ জীবনের। শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক দুর্দশার।
আদি অধিবাসী চামোরোসহ ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের গুয়াম আমেরিকারই অঞ্চল। কিন্তু এই দ্বীপের মানুষ আমেরিকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ভোট দিতে পারে না। যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্র গুয়ামবাসীদের জীবনকে কতোটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে, শত্রুপক্ষ শক্তি দেখাতে থাকলে আদৌ তারা এই দ্বীপ নিয়ে ভাববে কিনা, তা নিয়েই চিন্তায় ‘সবসময়ই স্বার্থে ব্যবহৃত’ গুয়ামবাসী।
ওয়াশিংটন পোস্টে গুয়ামের বাসিন্দা ও সাংবাদিক শ্যানন জে মার্ফির লেখা অবলম্বনে অনুবাদ করেছেন নওশাদ হক তিয়াস
বাংলাদেশ সময়: ২২২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৭
এনএইচটি/এইচএ/