ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা, উদ্বেগ ১৩% গর্ভবতী নিয়েও

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা, উদ্বেগ ১৩% গর্ভবতী নিয়েও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প, ছবি: দীপু মালাকার

কারো হাম, কারো বা অপুষ্টি। কারো কারো আবার সহিংসতার দৃশ্যপট দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার উপক্রম। তারা কেউই ভালো নেই। আবার আগের চেয়ে তো ভালোই!

রোগে-শোকে ভোগা রোহিঙ্গা শিশুদের অবস্থা এমনই করুণ। নিয়তির কাছে তাদের পরাজয় নিত্যদিনের।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিল-ইউনিসেফ বলছে, মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতার জেরে পালিয়ে আসা চার লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় আড়াই লাখই শিশু। তাদের পুষ্টি, পোলিও, স্বাস্থ্যগত দিক উন্নয়নই এখন শরণার্থী শিবিরের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির অভাব, পর্যাপ্ত খাদ্য না পাওয়া; পুষ্টিহীন হয়ে দুর্বলতা, স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকা; মেয়ে শিশুদের প্রজনন স্বাস্থ্যের (প্রাপ্তবয়স্ক নারীসহ) ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিল ইউনিসেফের মুখপাত্র ক্রিস্টোফ বুলিয়ার্ক বলেছেন, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো সম্পূর্ণ জনাকীর্ণ। এছাড়া কাদা, ধুলাবালুতে ভরপুর। এমন পরিবেশে শিশুদের জন্য ঝুঁকি থেকে যায়; বিশেষ করে কোলের শিশুদের। পাশাপাশি খোলা আকাশের আবহাওয়াও তাদের ঝুঁকির অন্যতম কারণ।

বিপুল জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করার সমস্যার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে আমরা জনসংখ্যার শুমারি করছি। তবে এটি দুরূহ কাজ। প্রতিদিনই লোক বাড়ছে, নতুন নতুন মুখ যোগ হচ্ছে।

শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সংস্থাটির এক হিসেব বলছে, চার লাখের অধিক রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ শিশু। এক হাজার ২৬৭ শিশুর বাবা-মা-অভিভাবক কেউ নেই। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের বসবাস, ছবি: দীপু মালাকার

সাধারণ শিশু ছাড়াও পরিবারহীন শিশুরা পৃথকভাবে পাচারের শঙ্কায় রয়েছে। আরও ঝুঁকি রয়েছে যৌন নিপীড়নের, শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের, উল্লেখ করেন ক্রিস্টোফ বুলিয়ার্ক।

শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর পাশে ইউনিসেফ এখন পর্যন্ত ৪১টি ‘শিশু জোন’ তৈরি করেছে। এতে তাদের খেলাধুলা, বিনোদনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কোন শিশুর মানসিক অবস্থা কী সেটি উঠে আসবে খুব সহজেই বলেছে সংস্থাটি। এছাড়া যেসব শিশুর অভিভাবক নেই তাদের ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি; মানসিক ও শারীরিকভাবে। এরমধ্যে মেয়েদের অবস্থা নাজুক, তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কাও অনেক বেশি।

ইউনিসেফ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি শিশুর জন্য খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় সেবা প্রাপ্তি বাড়ছে।

এদিকে শিশুবান্ধব শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে তোলার কথা তুলে ধরেছেন ক্রিস্টোফ বুলিয়ার্ক।  

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তিনভাগের দুইভাগ নারী। যাদের ১৩ শতাংশ গর্ভবতী। এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যা কমার কোনো লক্ষ্যণ নেই বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি। এছাড়া প্রতিদিনই ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে নবজাতক। জন্মের পর তার সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও সুনির্দিষ্টতা নেই।

রোহিঙ্গা শিশুদের সহায়তার জন্য ইউনিসেফ আগামী চার মাসে দাতা দেশগুলোর কাছে ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার সহায়তা চেয়েছে। এই সহায়তা এলে তারা সেবার আওতা আরও বাড়াতে পারবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৪ জনকে শনাক্ত করা গেছে, যারা সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। হাম, যক্ষ্মা, হেপাটাইটিস বি এবং সি রোগ রয়েছে। এমনকি এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত রোগীও শনাক্ত করা গেছে। এ নিয়ে সতর্কতা জারি করার মতো পরিস্থিতি না হলেও শঙ্কা রয়েছে। এসব রোগী চট্টগ্রাম, কক্সবাজার; টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা, ছবি: দীপু মালাকার

চিকিৎসকরা বলছেন, মিয়ানমারে বাংলাদেশের চেয়ে এইচআইভি-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে অরক্ষিত যৌনাচার রয়েছে। এছাড়া নারীদের অনেকে যৌন হয়রানির শিকার। এই জনগোষ্ঠী নিজ দেশে চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত ছিল। সব মিলিয়ে পুরো গোষ্ঠীই ঝুঁকির মধ্যে।

এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ শিশুকে টার্গেট করে পোলিও হামসহ অপুষ্টিজনিত নানা রোগের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। যেখানে শিশুদের বয়স ছয় মাস থেকে ১৫ বছর।

স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারে বিভিন্ন ত্রাণ প্রেরণকারী দেশও। মালয়েশিয়া এই আহ্বান জানিয়েছিল। অবশ্য পরে তারা কেবল ত্রাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রাণ ব্যবস্থাপনা যেমন জরুরি, তেমনি রোহিঙ্গাদের সার্বিক কার্যক্রমও ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ সরকার উন্নত দেশগুলোকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নিতে আহ্বান জানাতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনে নিন্দার সুরে কথা বলছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের বলা হচ্ছে বিশ্বের সব থেকে ‘বন্ধুহীন’ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। অবিলম্বে সেনা অভিযান স্থগিত ও রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সংখ্যা সোয়া চার লাখ ছাড়িয়েছে। বেসরকারি হিসেবে এটি পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া সহিংসতায় দেশটিতে প্রাণ গেছে তিন হাজারের বেশি মানুষের, বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা আরও বেশি। অসমর্থিত কোনো কোনো সূত্রে এটি দশ হাজার।

গত ২৪ আগস্ট থেকে চলা সবরকম সংঘাত বন্ধে রোহিঙ্গাদের সংগঠন ‘দ্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)’ এক মাসের জন্য অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেদেশের সরকার সেটি উপেক্ষা করেছে। ফলে এখনও চলছে সংঘাত। মানুষের মৃত্যু যেমন হচ্ছে তেমনি প্রাণ ভয়ে তারা পালিয়ে ঢুকছেন নিরাপদ আশ্রয় বাংলাদেশে। তাদের এই চাপ সামলাতে উন্নয়ন সংস্থাগুলো হিমশিম খাচ্ছে, তেমনি বড় মাথা ব্যথা সরকারের জন্যও।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭
আইএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।