শুক্রবার (২৭ এপ্রিল) দু’দেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম ‘পানমুনজমে’ দুই প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক বৈঠকের পর এক যৌথ ঘোষণায় এ কথা জানানো হয়। যৌথ ঘোষণায় সই করেন কিম ও মুন।
দুই নেতা যে বাড়িতে এই ঐতিহাসিক বৈঠক করেন, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পিস হাউস’ বা শান্তির বাড়ি। এই শান্তির বাড়িতে কিম ও মুনের মধ্যে আলোচনার পর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইয়ুন ইয়াং-চ্যান এক বিবৃতিতে বলেন, দুই রাষ্ট্রপ্রধান কোরীয় উপদ্বীপে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ও দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে আন্তরিক ও খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তারা গুরুত্বের সঙ্গে আলাপ করেছেন আন্তঃকোরিয়া সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি নিয়েও।
চ্যানের ওই বিবৃতির পর দেওয়া যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, ‘পুরোপুরি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মাধ্যমে পরমাণুমুক্ত কোরিয়া উপদ্বীপ গড়ে তোলার অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া দৃঢ়ভাবে একমত। কোরীয় উপদ্বীপে আর কখনও যুদ্ধ হবে না। আর এখান থেকেই শান্তির নবযুগের সূচনা হলো। ’
যৌথ ঘোষণায় জানানো হয়, আগামী মে মাসেই পিয়ংইয়ং ও সিউলের শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক সংলাপ হবে। পূর্ণমাত্রায় চুক্তিকে এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে নিয়ে বহুপাক্ষিক সংলাপও করবে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া।
যৌথ ঘোষণায় সইয়ের পর এক উচ্ছ্বাসপূর্ণ বিবৃতিতে কিম জং-উন বলেন, ‘আমরা সবাই এই মুহূর্তের জন্য দীর্ঘ-প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমি আশা করি দুই কোরিয়া আবার ‘পুনর্মিলিত’ হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে ঐতিহাসিক আলোচনা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন আর দীর্ঘায়িত হতে পারে না। ’
গত শতাব্দীতে হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই আলাদা হয়ে যায় দুই কোরিয়া। এরপর দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালের জুন থেকে ১৯৫৩ সালের জুলাই পর্যন্ত দুই কোরিয়ার মধ্যে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয়। তিন বছরেরও বেশি সময়ের ওই যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার পক্ষে ছিল চীন ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), আর দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে ছিল জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পশ্চিমা জোট। যুদ্ধে আনুমানিক সাড়ে সাত লাখ উত্তর কোরীয় ও পৌনে দুই লাখ দক্ষিণ কোরীয় নিহত হয়।
ওই যুদ্ধের পর থেকে এই দীর্ঘ সময়ে কেবল বিচ্ছিন্নতা, সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরে উত্তেজনার উত্তাপই ছড়াচ্ছিলো কোরীয় উপদ্বীপে। এমনকি গত বছরের শুরু থেকে এ বছরের শুরু পর্যন্ত উপদ্বীপটি ঘেঁষে সামরিক যুদ্ধযানের মহড়াও আতঙ্ক ছড়াচ্ছিলো। উত্তর কোরিয়ার দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও ‘পরমাণু বোমা’র পরীক্ষার প্রস্তুতির খবরে মিত্র দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘রক্ষায়’ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধবিমানবাহী একাধিক রণতরী পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রও। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে ‘শায়েস্তা’ করার হুমকি দিলে পিয়ংইয়ং উল্টো তাদেরই ‘পস্তানো’র হুঁশিয়ারি দেয়।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ার শান্তিকামী প্রেসিডেন্ট মুনের প্রচেষ্টায় উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা কমে আসে। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প আলোচনায় বসতে সম্মত হন। আগ্রহ দেখান শান্তি প্রক্রিয়ায়। সেই আগ্রহের ফল দেখা যায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ায় শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। কিম ও মুনের বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণা যেন শান্তি প্রক্রিয়ার ‘অগ্রবার্তা’ দিচ্ছে বিশ্বকে।
এই অগ্রবার্তাকে স্বাগত জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ গোটা বিশ্ব। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হয়, ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়ায় বেইজিং সাধুবাদ জানাচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদ্বয়কে। একইসঙ্গে তাদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সাহসের প্রশংসা করছে। চীনের প্রবাদ অনুযায়ী বলতে হয়, ভাইয়ের বন্ধন ছিন্ন করার মতো শক্তি বিপর্যয়ের নেই। আমরা আশা করি এই ঐতিহাসিক বৈঠকের মাধ্যমে কোরীয় উপদ্বীপে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার যে নতুন পথ তৈরি হলো, তা লুফে নেবে দুই পক্ষ। ’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে দু’পক্ষকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘শেষ হচ্ছে কোরিয়ার যুদ্ধ! কোরিয়ায় এখন যা ঘটছে, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মহান জনগণের গর্বিত হওয়া উচিত। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৮
এইচএ/
আরও পড়ুন
** কোরিয়া যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানে এ বছরই চুক্তি
** দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলেন উত্তরের নেতা কিম