ঘানার এ কূটনীতিক সুইজারল্যান্ডে থাকছিলেন। সেখানেই তিনি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, নিজের শেষ দিনগুলোতে আনানের পাশে ছিলেন তার স্ত্রী ন্যানে, তিন সন্তান আমা, কোজো ও নিনা। তার সমাধি প্রক্রিয়া পরবর্তীতে জানিয়ে দেওয়া হবে।
কফি আনান ফাউন্ডেশনের বিবৃতিতে তাকে ‘বৈশ্বিক কূটনীতিক ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আন্তর্জাতিকতাবাদী’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়পরায়ণ বিশ্ব গড়তে জীবনভর লড়ে গেছেন তিনি। যেখানেই দুর্ভোগ বা মানবিক আর্তি ছিল, সেখানেই ছুটে গিয়ে গভীর সমবেদনা ও সমানুভূতিতে হৃদয় জিতেছেন বহু মানুষের। নিঃস্বার্থভাবে অন্যদের কথাই আগে ভেবেছেন তিনি, যা করেছেন- সবকিছুতেই ছড়িয়েছে সত্যিকারের মমতা, আন্তরিকতা আর মেধার দ্যুতি।
১৯৯৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জাতিসংঘ মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বশান্তিতে অবদানের জন্য ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন কফি আনান।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থার সর্বোচ্চ কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালনের পর কফি আনান জাতিসংঘ-আরব লিগের বিশেষ দূত হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে সংকট নিরসনে যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়েও ফল না আসায় হতাশ হন তিনি।
সবশেষ মিয়ানমার রাখাইনে দমন-পীড়ন চালিয়ে রোহিঙ্গা সংকট তৈরি করলে দেশটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ কমিশন গঠনের মাধ্যমে এর সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা চালান কফি আনান। তার নামে গঠিত আনান কমিশনের সুপারিশমালা ব্যাপক প্রশংসিত হয় বাংলাদেশসহ বিশ্ব দরবারে।
আনানের প্রয়াণে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতিয়েরেসসহ বিশ্বনেতারা।
কুমাসির উপজাতি পরিবার থেকে বিশ্বশান্তির দূত
কফি আনান ১৯৩৮ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত ঘানার কুমাসি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা-বাবা উভয়ের পরিবারই উপজাতি গোষ্ঠীর শীর্ষ পর্যায়ের পরিবারের সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে বাবা ছিলেন আবার শিক্ষিত। সে হিসেবে উপজাতীয় ও আধুনিক-উভয় সংস্কৃতি গায়ে মেখেই বড় হন আনান।
ঘানার একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি কুমাসির কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেন। ২০ বছর বয়সে স্কলারশিপ পেয়ে আনান যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ম্যাসালেস্টার কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে অর্থনীতি বিষয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে দক্ষ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আনান যেন বিশ্বজয়ী কূটনীতিক হওয়ার জানান দিচ্ছিলেন।
১৯৬১ সালে তিনি ওই কলেজ থেকেই অর্থনীতি উচ্চতর ডিগ্রি নেন। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার পাঠ চুকে আনান চলে যান সুইজাল্যান্ডের জেনেভায়। সেখানে তিনি গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারনশ্যানাল অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট স্টাডিজে অর্থনীতির ওপরই আরেকবার স্নাতক ডিগ্রি নেন।
জেনেভায় পড়াশোনার পর আনান জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (হু) যোগ দেন। সংস্থাটিতে প্রশাসনিক ও বাজেট কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাকে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে পদায়ন করা হয়। আনান বরাবরই মাতৃভূমিতে ফিরতে চাইলেও আফ্রিকান দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা তাকে বারবার দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।
এরমধ্যে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আলফ্রেড পি. স্লোয়ানে ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে ফেলোশিপটি শেষ করার পর আনানকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার অব সায়েন্স ডিগ্রিতে ভূষিত করা হয়। পরে ঘানায় ফেরার বদলে তিনি নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদরদফতরে চাকরিতে যোগ দেন।
১৯৭৪ সালে আনান জাতিসংঘ ইমারজেন্সি ফোর্সের চিফ সিভিলিয়ান অফিসার হিসেবে কায়রোতে পদায়ন লাভ করেন। তবে সে বছর ওই দায়িত্ব ছেড়ে ঘানায় গিয়ে দেশটির পর্যটন উন্নয়ন কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে যোগ দেন।
এরপর আনান আবার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘে যোগ দেন। সাত বছর তিনি জেনেভায় জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনে (ইউএনএইচসিআর) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদফতরে ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অফিসে বাজেট পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই দশকের শেষ দিকে তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা সমন্বয়ক পদে কাজ করেন। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের অফিস অব প্রোগ্রাম প্ল্যানিং, বাজেট অ্যান্ড ফিন্যান্সের সহকারী মহাসচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন আনান।
এই দীর্ঘ সময়ে তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা থেকে ব্যবস্থাপনা, সবক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। এমনকি ১৯৯০ এর দিকে কুয়েত যুদ্ধের সময় ইরাক থেকে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্যও মধ্যস্থতা করেছিলেন আনান।
এতো বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান দেখিয়ে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে সংস্থার মহাসচিব পদে নিয়োগ পান আনান। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি। এতো বড় পদে দায়িত্ব পেলেও আনান তার অতীত ক্যারিয়ারের মতোই ছিলেন নরমভাষী। এই নরম ভাষায়ই ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেইনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছিলেন তিনি।
প্রথম মেয়াদে জাতিসংঘের কার্যক্রমে অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন আনায় আনানকে ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় জাতিসংঘ মহাসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০১ সালে জাতিসংঘের সঙ্গে আনানকেও যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
ওই পুরস্কার প্রদানের কারণ হিসেবে তখন নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আনান জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা সংস্থাকে নতুন রূপ দিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় আরও বেশি তৎপর করেছেন। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং এইডসের মতো দুরারোগ্য রোগের প্রতিরোধে তার কার্যকর পদক্ষেপই জাতিসংঘকে বিশ্ববাসীর দরবারে আরও সম্মানিত করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৮
এইচএ/