সুতরাং কেউ ৪৮ মাইল সফরের নিয়তে বের হলো না, অথচ নিয়ত ব্যতিত সারা দুনিয়া ঘুরে এলো, সে মুসাফির হিসাবে গন্য হবে না। (রদ্দুল মুহতার: ২/১২১)
মুসাফিরের ‘ওয়াতনে আসলি’ (মূল বাড়ি)
ওয়াতনে আসলি মানুষের এমন নিজস্ব বাসস্থানকে বলে যেখানে সে জন্মগ্রহণ করেছে কিংবা তার পরিবার বসবাস করে কিংবা সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করেছে।
ওয়াতনে আসলির জন্য বাড়ি, জায়গা ও স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত জরুরি। (প্রাগুক্ত) ওয়াতনে আসলির হুকুম হলো, ওয়াতনে আসলিতে মানুষ মুকিম গণ্য হয়। সেখানে মুসাফিরের হুকুম চলে না।
একাধিক ওয়াতনে আসলি
ওয়াতনে আসলি একাধিক হতে পরে। যেমন কেউ নতুন করে শহরে বাড়ি করলো। আর পূর্ব থেকে তার গ্রামে বাড়ি রয়েছে। এখন সে যদি উভয় বাড়িতে আসা-যাওয়া করে এবং উভয়টিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করে তবে উভয়টি তার জন্য ওয়াতনে আসলি হবে। (আল-বাহরুর রায়েক: ২/১৩৬)।
মোটকথা ওয়াতনে আসলি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিয়তই মূল। সে যদি দুটি স্থানকে ওয়াতনে আসলি বানায় এবং উভয়টিতে স্থায়ীভাবে থাকার নিয়ত করে (এখানে কিছু দিন ওখানে কিছু দিন) তবে উভয়টি তার জন্য ওয়াতনে আসলি গণ্য হবে। (ফাতাওয়া উসমানি: ১/৫৪৬)।
আর ওয়াতনে আসলি তখনই বাতিল হয় যখন সেটাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার নিয়ত করা হয়।
(বাদায়েউস সানায়ে: ১/২৮০; আদ্দুররুল মুখতার: ২/১৩১; তাবয়িনুল হাকায়েক: ১/২১৪; আলমুহিতুল বুরহানি: ২/৪০১; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/১৯৮; আলবাহরুর রায়েক: ২/১৩৬; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া: ২/১৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/১৪২; ফাতাওয়া খানিয়া: ১/১৬৫)
স্ত্রী যদি শশুর বাড়িতে বসবাস করে আর স্বামী তার কাছে বেড়াতে যায়, তাহলে সে সেখানে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে। তখন শশুরালায় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি স্ত্রী স্বামীর বাড়িতে বসবাস করে আর বাপের বাড়িতে বেড়াতে যায়, তাহলে তার শশুর বাড়িতে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে।
স্বামীর জন্য তার শশুরালয়
সাধারণত তিন কারণে ওয়াতনে আসলি প্রমাণিত হয়। (১) জন্মস্থান (২) শশুরালয় যদি সেখানে স্ত্রী বসবাস করে। (৩) অথবা এমন কোনো স্থান যেখানে স্বপরিবারে বসবাস করার জন্য নির্ধারণ করা হয়। তবে শশুরালয় শুধু বিবাহ করলেই তার ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে না। বরং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করতে হবে। ফুকাহায়ে কেরামের বিভিন্ন উদ্বৃতি দ্বারা এমনটাই বুঝে আসে। নিম্মে কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো।
এক. আল্লামা কাজিখান (রহ.) বলেছেন, ‘ওয়াতনে আসলি এমন স্থান, যেখানে জন্মস্থান হিসেবে বসবাস করছে অথবা জন্মস্থান নয়; তবে বিবাহ করে তাকে স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে। ’ (ফাতওয়ায়ে কাজীখান ১/৮০)
দুই. আল্লামা ইবনে হুমাম (রহ.) বলেন, ‘ওয়াতনে আসলি বা স্থায়ী বাসস্থান হলো, জন্মস্থান বা বিবাহ করে যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ইচ্ছা রয়েছে। ’ (ফাতহুল কাদির: ২/১৬)
তিন. হজরত উসমান (রা.) মক্কা সফরে পূর্ণ চার রাকাত নামাজই পড়তেন। লোকেরা এতে বিরক্ত হলে তিনি বলেন, আমি মক্কা শরিফ বিবাহ করেছি আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কোনো শহরে বিবাহ করল সে সেখানে মুকিমের ন্যায় নামাজ পড়বে। ’ (মুসনাদে আহমাদ ১/৬২)
উপরযুক্ত উদ্ধৃতিগুলো দ্বারা বুঝা যায়, শুধু বিবাহ করলেই সেখানে মুকিম হবে না। বরং তাকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করতে হবে। এজন্যই আল্লামা কাজিখান ‘তাকে স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে’ ও আল্লামা ইবনে হুমাম (রহ.) ‘সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছা রয়েছে’ শর্ত জুড়ে দিয়েছেন।
আর হজরত উসমান (রা.) যে মক্কা সফরে দুই রাকাত পড়তেন তার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে ‘কিফায়া’ নামক কিতাবে। সেখানে বলা হয়েছে, হজরত উসমান (রা.) এর এক পরিবার ছিল মক্কায়, আরেক পরিবার ছিল মদীনায়। তাই উভয় স্থানে তিনি মুকিমের মতো নামাজ পড়তেন। (কিফায়া ২/১৭)
তাছ্ড়া শুধু শশুরালয় হলেই যদি মুসাফির হয়ে যেত তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন ও বিদায় হজের দিন কসর পড়তেন না। কেননা সেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই স্ত্রী সাওদা (রা.) ও মাইমুনা (রা.) এর পিত্রালয় ছিল। অথচ সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় কসর পড়েছেন। (ইমদাদুল আহকাম: ১/৬০৪)
এ বিষয়ে আরও কিছু ফতওয়ার কিতাবের উদ্ধৃতি—
(১) আল্লামা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.) লেখেন, বিবাহের পর স্ত্রীকে শশুরালয়ে না রেখে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসলে স্ত্রীর পিত্রালয় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলি গণ্য হবে না। স্বামী সেখানে গেলে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি স্ত্রীকে তার পিত্রালয়ে বসবাসের নিয়তে রাখে তাহলে স্ত্রীর পিত্রালয় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে। (ইমদাদুল আহকাম: ১/৬০৫)
(২) মুফতি আজিজুর রহমান (রহ.) লেখেছেন, বিবাহের স্থান ওয়াতনে আসলি হিসেবে কেবল তখনই গণ্য হবে যখন যেখানে স্বপরিবারে থাকার ইচ্ছা থাকে। এমন নয় যে, বিয়ের পর স্ত্রীকে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে আসার পর ও স্বামীর জন্য শশুরালয় ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে। (ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম: ৪/৪৮৩)
স্ত্রীর জন্য তার বাপের বাড়ি
বিবাহের পর স্ত্রীর জন্য তার বাপের বাড়ি ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য। যদিও সে স্বামীর সংসারে চলে যায়। কেননা এটা তার জন্মসূত্রে ওয়াতনে আসলি এবং নতুন যে বাড়িতে সে বসবাসের জন্য উঠবে সে বাড়িও তার ওয়াতনে আসলি। ওয়াতনে আসলি দ্বারা ওয়াতনে আসলি বাতিল হয় না। তবে যদি দুটি ওয়াতনে আসলি কোনো একটি পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ করার ইচ্ছা করে তাহলে সে ক্ষেত্রে ওয়াতনে আসলি বাতিল হয়ে যাবে। সুতরা নিজের বাসস্থানের বাড়ি বা বাপের বাড়ি কোনো একটি যতক্ষণ না পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ করার ইচ্ছা না করে ততক্ষণ সেই বাড়ি তার ওয়াতনে আসলি হিসেবে বহাল থাকবে। এব্যাপারে ইবনে হুমাম (রহ.) বলেন, ‘কেউ যদি একটি বাসস্থান গ্রহণ করার পর সেটি পরিত্যাগ করে অন্য আরেকটি বাসস্থান গ্রহণ করে তাহলে প্রথম বাসস্থান তার জন্য ওয়াতনে আসলি হিসেবে বহাল থাকে না। তবে যদি সে কোনোটিই পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ না করে তবে উভয়টিই তার জন্য ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে। (ফাতহুল কাদির: ২/১৬)
ওয়াতনে আসলি ত্যাগ করা ব্যতিত অন্য আরেকটি ওয়াতনে আসলি গ্রহণ করলে প্রথমটি ওয়াতনে আসলি বাতিল হয় না। (ফাতহুল কাদির: ২/১৬)
আরও পড়ুন: ভ্রমণে নামাজ যেভাবে পড়বেন
আল্লামা নুজাইম (রহ.) স্বীয় গ্রন্থ আল বাহরুরায়েক বলেন, একটি একটি ওয়াতনে আসলি কেবলমাত্র আরেকটি ওয়াতনে আসলি দ্বারাই বাতিল হয়। অন্য কোনো বাসস্থান দ্বারা নয়। অর্থাৎ অন্য কোনো বাসস্থান তৈরি করে সেখানে নতুন করে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিলেই প্রথম বাসস্থানটি ওয়াতনে আসলি হিসেবে বাতিল হবে। পরে পুরাতন বাসস্থানে গেলে নামাজ কসর করবে। আর যদি পূর্বের বাসস্থানটি পরিপূর্ণভাবে ত্যাগ না করে তাহলে পুরাতন বাড়ি গেলে সেখানে সে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে। (আল বাহরুর রায়েক: ২/১৩৬)
তবে কোনো নারী পিত্রালয়কে পরিপূর্ণভাবে ত্যাগ করে না। বরং পিত্রালয়কেই তার আসল বাড়ি মনে করে। এ জন্যই কোনো কারণে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাহলে তাদেরকে পিত্রালয়ে আসতে দেখা যায়। আমাদের সমাজের রীতি-নীতি অনুযায়ী স্ত্রীর পিত্রালয়কেই তার আসল বাড়ি গণ্য করা হয়। এই সামাজিক রীতি-নীতিকে শরিয়তের পরিভাষায় উরফ বলা হয়। উরফ ও শরিয়তের একটি দলীল। এ বিষয়ে আল্লামা শামি (রহ.) বলেন, ‘উরফ ও আদাত তথা প্রচলিত রীতি-নীতি শরিয়তে গ্রহণযোগ্য, যদি তা শরিয়ত পরিপন্থী না হয়। এর ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য মাসআলা প্রণীত হয়। এ জন্যই শরিয়তবিদগণ উরফ ও আদাতকে একটি মূলনীতি হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। (শরহে উকুদে রসমিল মুফতি: ৩৭)
এছাড়াও বহু ফিকহের কিতাবে স্ত্রীর পিত্রালয়কে স্ত্রীর ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফতওয়ায়ে কাজীখানের এক স্থানে বলা হয়েছে, ‘ওই মহিলাও মুসাফির গণ্য হবে যাকে তার স্বামী সফর অবস্থায় তালাক দিয়েছে। এমতাবস্থায় তার ইদ্দত ও শেষ হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে মুফতি আব্দুর রহীম লাজপুরী রহঃ বিবাহের পর স্ত্রী স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে সে সেখানে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে এবং পূর্ণ নামাজ পড়বে। তেমনি পিত্রালয়ে গেলেও পূর্ণ নামাজ পড়বে। কেননা সে পিত্রালয় সম্পূর্ণ ত্যাগ করে চলে আসেনি। স্বামী শশুরালয়ে গেলে মুসাফির হিসেবে নামাজ পড়বে। (যদি নিজ বাড়ি থেকে শশুড়ালয় ৪৮ মাইল বা ৭৭.২৫ কিলোমিটার অথবা ততধিক দূরবর্তী হয়। হ্যাঁ, স্ত্রীকে শশুরালয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে এবং পূর্ণ নামাজ পড়বে। (ফাতওয়ায়ে রহিমিয়্যাহ: ৫/১০)
লেখক: সম্পাদক, মাসিক আলহেরা (আরবি ম্যাগাজিন)
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা ও প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৯
এমএমইউ