মাঝবয়সী এই মেলার শুরুটা কিন্তু হঠাৎ করেই হয়েছিলো। আর পরিকল্পনাটা (ব্লু প্রিন্ট) হয়েছিলো কলকাতার বইপাড়ায়, মান্না দের স্মৃতিবিজড়িত কফি হাউসে বসে।
সালটা ছিলো ১৯৭৪। দুপুরেবেলা কফি হাউসে আড্ডায় মশগুল কয়েকজন তরুণ সাহিত্যপ্রেমী, লেখক ও প্রকাশক। তখন স্মার্টফোন মানুষকে গ্রাস না করলেও বই এত সহজলভ্য ছিলো না। কিন্তু বই পড়ার আগ্রহটা তখনও সব বাঙালির মধ্যেই ছিলো। তাই গল্পের ছলে প্রসঙ্গ ওঠে বাংলা বইয়ের বিক্রি নিয়ে। কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায় বাঙালি প্রকাশনার জগতটাকে। কীভাবে বেশি করে বাংলার বই বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া যায়?ওইদিন আড্ডাপ্রেমী বাঙালি, কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে প্রকাশকদের বাংলার ঘরে ঘরে বেশি করে পরিচিত করাই ছিলো আড্ডার বিষয়। কফি হাউসে বসেই ঠিক করা হলো কলকাতায় ইচ্ছুক প্রকাশকদের পসরা নিয়ে একটি বইমেলার আয়োজন করা হবে। কালের চাকায় পথচলা শুরু হলো কলকাতা বইমেলার। শুরুর দিকে এই সিদ্ধান্তে অনেকে প্রকাশকই নাক সিটকে ছিলেন। বিরোধীদের মত ‘ভালো লেখক, ভালো সাহিত্য আর পকেট ভারী প্রকাশক হলে বই এমনিতেই পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাবে। ’ কিন্তু এসব প্ররোচণায় দাবানো যায়নি সেদিনের বইমেলার উদ্যোগ। প্রথম মেলায় ৩৪ জন প্রকাশক মিলে ৫৪টি স্টল দিয়েছিলো। তখন বেশিরভাগ প্রকাশক অংশ নেননি বইমেলায়।
১৯৭৫ সালে তৈরি হলো ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড’। তখন গিল্ডের প্রথম সভাপতি হলেন সুশীল মুখোপাধ্যায়। অবশেষে ১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ শুরু হয়েছিলো প্রথম কলকাতা বইমেলা। বর্তমানে যেখানে বাংলাদেশ বইমেলা হয় অর্থাৎ কলকাতার রবীন্দ্রসদনের পশ্চিম পাশে মোহরকুঞ্জে, তখন বইমেলা সেখানেই শুরু হয়েছিলো। চলেছিলো ১৪ মার্চ পর্যন্ত। তখনও আন্তর্জাতিক তকমা পায়নি কলকাতা বইমেলা। প্রথম বছর বইমেলা ছিলো নানা দিক থেকে স্মরণীয়। তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছিলো কলকাতায়। ফলে মেলা প্রাঙ্গণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে চেষ্টা চালান মেলার স্বেচ্ছাসেবক দল। সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন স্বয়ং বইমেলার সভাপতি। তিনি পাঞ্জাবি খুলে, স্রেফ একটি গেঞ্জি গায়ে মেলা প্রাঙ্গণে নেমে পড়লেন জলাবদ্ধতা নিরসনে। কাজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন মেলা প্রাঙ্গণের বাইরে। মেলায় ফের ঢুকতে গেলে তাকে আটকে দেয় নিরাপত্তাকর্মীরা। অর্ধ উলঙ্গ হয়ে বইমেলায় এসেছেন কে এই লোক? তাদের বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছিলো বুঝতে যে, ওই লোকটিই মেলার সভাপতি।
বছর পাল্টাতে থাকে বইমেলার চেহার ও চরিত্রের। ভারতের প্রথম ‘কলকাতা বইমেলার জনপ্রিয়তাও ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশে-বিদেশে। এরপর ১৯৮৩ সালে বইমেলায় এসেছিলেন আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক। মেলা দেখে আবেগে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই বছরই কলকাতার বইমেলার মুকুটের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘আন্তর্জাতিক’ তকমা। গোটা পৃথিবীর কাছে ‘কলকাতা বইমেলা’ পরিচিতি পায় ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার নামে।
যত সময় যেতে থাকে, মেলার আকার ও জৌলুস ততই বাড়তে থাকে। ফলে স্থান পরিবর্তন হতে থাকে মেলার। ১৯৮৮ সালে বইমেলা এলো পার্ক স্ট্রিটে। আজ যা গড়ের মাঠ নামে পরিচিত। তারপর থেকেই ময়দান আর বইমেলা যেন সমার্থক হয়ে যায়। তখনও থিম কান্ট্রি বা ফোকাল থিম কী তা তখনও বইমেলার অন্দরে প্রবেশ করেনি। ১৯৯১ সালে প্রথম ফোকাল থিম দেখে কলকাতা বইমেলা। প্রথমবার ভারতের আসাম রাজ্যকে সম্মান জানিয়ে থিম হয়েছিল ‘আসাম’। ১৯৯৪ সালে প্রথমবার হয় ‘থিমকান্ট্রি’। তখন ‘থিমকান্ট্রি’ ছিলো জিম্বাবুয়ে। এরপরের বছর ‘পশ্চিমবঙ্গ’একবারের জন্য হয় বইমেলার ফোকাল থিম।
এরপর আসে বইমেলার কালো দিন। ১৯৯৭ সাল, বইমেলার ‘থিমকান্ট্রি’ ছিলো ফ্রান্স। উদ্বোধনে এসেছিলেন জাক দেরিদা। চরম ব্যস্ত বইমেলা। ষষ্ঠ দিনে, দুপুরের পর ময়দানের আকাশে দেখা যায় কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া আকাশের দিকে উঠছে। মেলায় ঘটে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড। মুহুর্তে পুড়ে যায় লাখেরও বেশি বই। ওই দেখে ঘটনাস্থলেই জীতেন শীল নামে এক বইপ্রেমী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে মেলা প্রাঙ্গণেই তার মৃত্যু হয়। তিন দিন বাদে ফের সেজে ওঠে মেলা। সেই অগ্নিকাণ্ডের পর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। কিন্তু সেই ক্ষত আজও বহন করে চলেছে বইমেলা। আজও জীতেন শীলের স্মরণে মেলা প্রাঙ্গণে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর পরিবেশপ্রেমীদের এক মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয় ময়দানে আর বইমেলা করা যাবে না।
পরিবেশপ্রেমীদের দাবি, কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ময়দান দূষিত হচ্ছে বইমেলার কারণে। ওই সময়টা বাতাসে এতটাই ধূলিকণা ওড়ে যা মানুষের পাশাপাশি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ। কিন্তু মেলার গুরুত্বের কথা ভেবে প্রাথমিকভাবে ছাড় দেওয়া হয়। ফের ২০০৭ সালে পরিবেশপ্রেমীদের আন্দোলনের জেরে ময়দানের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছেদ ঘটে বইমেলার। সেবার এই বিচ্ছেদ এখনো বইপ্রেমীরা মেনে নিতে পারেননি। এরপরই বইমেলা চলে আসে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে। কিন্তু সেখানেও উঠে আসে পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্ন। ফলে বন্ধ হয়ে যায় সেই বছরের বইমেলা। এরপর বিকল্প স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া সল্টলেক যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণ। মেলা হারায় তার জৌলুস। কমে যায় পাঠক সংখ্যা। মাথায় হাত পড়ে প্রকাশকদের। বেচাকেনা পরপর তিনবছর জমে না।
এরপর ২০০৯ সাল থেকে এক ধরনের পাকাপাকি বইমেলার ঠিকানা হয় সায়েন্সসিটি লাগোয়া মিলনমেলা প্রাঙ্গণে। রাজ্য সরকার মিলনমেলা প্রাঙ্গণ রেনোভেট করতে গিয়ে ২০১৮ সাল থেকে মেলা চলে আসে সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে। যা এ বছর ৪৪ বছরের পদার্পণ করলো। ধীরে ধীরে বইপ্রেমীরাও মানিয়ে নেয় বইমেলার সঙ্গে।
এবারের বইমেলার ‘থিমকান্ট্রি’ রাশিয়া। বইমেলায় ৬শর বেশি স্টল হয়েছে। স্থান পেয়েছে সাড়ে ৪শর বেশি প্রকাশনা সংস্থা ও ২শ লিটল ম্যাগাজিনের স্টল। প্রতিবছরের মতো এবারও মেলায় প্রতিবেশী বাংলাদেশসহ ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, জাপান, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, গুয়েতেমালা, মেক্সিকো, পেরু ও লাতিন আমেরিকার ১১ দেশ মিলিয়ে মোট ২৯টি দেশ অংশ নিয়েছে। আছে ভারতের সবক’টি রাজ্য।