ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আদালত

মোবাইল কোর্ট না থাকা নিয়ে জনমনে অস্বস্তি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৫ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৭
মোবাইল কোর্ট না থাকা নিয়ে জনমনে অস্বস্তি মোবাইল কোর্টের ভেজাল বিরোধী অভিযানের খণ্ডচিত্র

ঢাকা: মোবাইল কোর্ট থাকা না থাকার বিষয়টি নিয়ে জনমনে দানা বেঁধেছে চরম অস্বস্তি। আম ও লিচুর মৌসুম আর রমজান মাস আসন্ন হওয়ায় এই অস্বস্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে ফরমালিন-কার্বাইড মুক্ত আম-লিচু ও ভেজাল মুক্ত খাদ্য না পাওয়ার শঙ্কা। জেলি আর ফরমালিনে ফের সয়লাব হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে চিংড়িসহ মাছের বাজার।

আমজনতার ঘুম যেনো তাই হারাম হওয়ার যোগাড়। আর অসাধু ব্যবাসায়ীদের সামনে অতি মুনাফার মচ্ছবে মাতার মওকা।

ভরা মৌসুমে তাহলে ফরমালিন আর কার্বাইডের বিষ থেকে আমপাগল আমজনতাকে রক্ষা করবে কে? কে ঠেকাবে চিংড়িসহ মাছের বাজারে জেলি আর ফরমালিনের নীরব ছোবল? ইলিশে পরিণত হওয়ার আগেই কি সস্তায় শেষ হতে থাকবে ঝাঁকে ‍ঝাঁকে জাটকা? রেস্তোরাঁয় মানসম্মত খাবারের নিশ্চয়তা কে দেবে? কারা করবে অবৈধ স্থাপনা আর পরিবেশ রক্ষা!

মৌসুম শুরুর আগেই এবার গত ৯ মে কার্বাইড দিয়ে পাকানো ৬৫ মণ আম ধ্বংস করা হয় মেহেরপুরের গাংনীতে। ১০ মে সাতক্ষীরায় চালতেতলা বাজারে একই কারণে ধ্বংস করা হয় আরো এক ট্রাক আম। এমন তৎপরতা কি আর দেখাই যাবে না দেশজুড়ে?মেহেরপুরে কার্বাইড দেওয়া আম ধ্বংস করা হচ্ছে  মোবাইল কোর্ট এর নির্দেশে।

বছর তিনেক ধরে ঢাকায় ঢোকার মুখে মোবাইল ‍কোর্টের চেক পোস্টে ধরা পড়ে ট্রাকে ট্রাকে ভেজাল আম পিষ্ট হচ্ছিলো চাকায়। কার্বাইড আর ফরমালিন আতঙ্কে ভুগতে থাকা দেশবাসী তাই বেশ আয়েস করেই আম, লিচু, কলা খেয়ে আসছিলো এতো দিন। রমজানে বেপরোয়া হয়ে ওঠা বাজার সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে  সবাইকে সব সময়ই স্বস্তি দিয়ে আসছিলো মোবাইল কোর্ট। চিংড়ির বাজার থেকে ক্ষতিকর জেলি ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছিলো তো ওই মোবাইল কোর্টই।

প্রজনন মৌসুমে উপকূল আর মোহনায় অব্যাহত অভিযানেই তো হারিয়ে যেতে বসা ইলিশ ফের উঠতে শুরু করেছে বাঙালির পাতে পাতে। বিমানবন্দরে বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের সমস্যা তাৎক্ষণিকই মিটিয়ে দেওয়ার নজিরবিহীন নজিরও তো দেশবাসী দেখতে শুরু করেছিলো মোবাইল কোর্টের কল্যাণে। বাল্য বিয়ে আর ইভ টিজিংয়ের মতো সামাজিক অপরাধ কি মোবাইল কোর্টের তৎপরতাতেই নিয়ন্ত্রণে আসে নি? রেস্তোরাঁগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার রান্না ও পরিবেশনে বাধ্য করলো কারা? অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ আর পরিবেশ রক্ষায় মোবাইল কোর্টের ভূমিকা তো সাদা চোখেই ধরা পড়ে।

২০০৯ সালে চালু হওয়ার পর থেকে গত ৮ বছরে কতো চড়াই-উৎরাই-ই তো পেরুলো মোবাইল কোর্ট।   তবু তো ঠিকই লড়াই করলো ভূমিদস্যুতা, বেপরোয়া দূষণ, অবৈধ বালু উত্তোলন, ড্রেজার চালানো বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাগ্রহণসহ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে। সরকারি সম্পদ ও জনস্বার্থ রক্ষায় অবিচল থেকে কতো সাঁড়াশি অভিযানই তো পরিচালনা করলো তারা। সহায়ক হলো সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায়।  

হালে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা সামাজিক অপরাধ- ইভটিজিং, মাদকাসক্তি, খাদ্য ও অষুধের মত অতি সংবেদনশীল দ্রব্যে ভেজাল দেয়া আর সামাজিক নিপীড়ণের ক্ষতে তাহলে আরোগ্যের প্রলেপ দেবে কারা? নিরাপদ খাদ্য আইন যথাযথ প্রয়োগে জনগণকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার কি উপায়? জন সম্পৃক্ততার কারণে ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কি সামাজিক ছোটখাট অপরাধের তথ্য খুব দ্রুত পাচ্ছেন না?বগুড়ায় চিংড়ি থেকে জেলি বের করছেন মোবাইল কোর্টের সদস্য।  ছবি: বাংলানিউজ

২০১৬ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিচারাধীন থাকা ৩১ লাখ ৯ হাজার ৯৬৭টি মামলার বাইরে ২০১৫ সালে এক বছরে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৫৪ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া কি ইতিবাচক নয়? ৫৭ হাজার ১৫৭টি মোবাইল কোর্টে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ টি মামলার নিষ্পত্তি জনমনে আশা জাগানিয়া নয় কি?

তাহলে মোবাইল কোর্ট কি জনগণের জন্য শাস্তি না স্বস্তি? গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ এ প্রতিষ্ঠিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত গ্রাম আদালতকেও কার্যকর করার চেষ্টা কি তবে মুথ থুবড়ে পড়বে?

এমন ব্যবস্থা কি আর কোনো দেশে নেই? সুদূর যুক্তরাজ্যের ‘লে ম্যাজিস্ট্রেট’ কি মূল বিচার ব্যবস্থাকেই সহায়তা করছে না? প্রতিবেশী ভারতে কি বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন না জেলা শাসক?  পাকিস্তান কি পুনরায় জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিভাগীয় কমিশনার পদ প্রবর্তন করেনি? ফ্রান্সের মতো অনেক দেশই কি প্রশাসনিক আদালত পরিচালিত হচ্ছে না?


জেলায় সরকার বা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জবাবদিহিতা তো জেলা প্রশাসকই করে থাকেন। অবাধে বৃক্ষ নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বার্থে কেউ রিট করলে জেলাপর্যায়ে প্রথম বিবাদী তো জেলা প্রশাসকই হন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের মাধ্যমে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ, পাবলিক পরীক্ষা আইনের মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগ, মহাসড়ক আইনের মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, মাদক আইনের মাধ্যমে মাদক বিভাগ, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে মহিলা বিভাগ, তথ্য আইনের মাধ্যমে তথ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনের মাধ্যমে নির্বাচন অফিস, ভোক্তা অধিকার আইনের মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, মৎস্য আইনের মাধ্যমে মৎস্য বিভাগ, পুলিশ আইন ১৮৬১ এবং The Code of Criminal Procedure, 1898-এর মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের যোগসূত্র কি স্থাপিত নয়?
অবাধে জাটকা শিকার
তাহলে মোবাইল কোর্টের ক্ষমতা জেলা ম্যাজিস্ট্র্রেটের না থাকলে সরকারি কাজে বাধা দানের তাৎক্ষণিক প্রতিকার দেবে কে? তৎক্ষণাৎ কে প্রতিরোধ করবে অবৈধ খাল ভরাট অপচেষ্টা? কে ঠেকাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ চুরি? সরকারি প্রয়োজনে গাড়ি রিকুইজিশন করবে কে? নির্বাহী বিভাগে অবাধ অনুপ্রবেশের প্রেক্ষিত তৈরি হলে তা কি মাসদার হোসেন মামলার পরিপন্থি হবে না?

রেলওয়ে আইন ১৮৯০-এর ১২৯ ধারা এবং ১৩০ ক ধারায় রেলওয়ের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীকে কি বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়া হয়নি? মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১৫৯, ১৬০ ও ১৬১ ধারায় পুলিশ কর্মকর্তাকে কি দেওয়া নেই বিচারিক ক্ষমতা? মেট্রোপলিটন আইনে পুলিশ কমিশনারের বিচারিক ক্ষমতা, RPO-তে নির্বাচনকালীন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ম্যাজিস্ট্রেসি, The Registration Act, 1908-এ সাব-রেজিস্ট্রারের বিচারিক ক্ষমতা, ট্যাক্স আইনে ট্যাক্স কর্মকর্তাদের দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা কি রহিত হয়েছে? নির্বাহী এসব প্রতিষ্ঠানে বিচারিক হাকিম পদায়ন হলে মাসদার হোসেন মামলার ১২ দফার নির্দেশনার যে চেতনা তা কি রক্ষা হবে?

আমলাদের হাতে আইন প্রয়োগের এই সুযোগ না থাকলে ভবিষ্যতে আইনের খসড়া প্রণয়ন, আইন অনুসারে মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনায়ও কি সমস্যা হবে না? যে জেলা প্রশাসক জেলায় সরকারের হাজার হাজার একর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও বিলিবণ্টন করেন ম্যাজিস্ট্রেসি ছাড়া সেই জেলা প্রশাসকের পদ কতোটা বাস্তব সম্মত?

এই মোব‍াইল কোর্ট তো মূলত নিম্ন আদালতেরই সহায়ক। এ কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তো আপীল করার সুযোগ অবারিত। আর এই আপীল তো শুনে থাকেন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাই। আর মোবাইল কোর্ট আইনের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রাপ্ত দ্রুত সেবাপ্রাপ্তির অনুসরণীয় এই মোবাইল কোর্ট তো আসলে জনগণের দোরগোরায় বিচার বা Justice at the door স্লোগানেরই অনন্য রূপ। বিনা খরচা ও বিনা হয়রানিতে তাৎক্ষণিক বিচার প্রাপ্তি এই মোবাইল কোর্টের উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক হয় কি?

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।