সোমবার (০৩ জুলাই) সকালে ওই সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে এ রায় ঘোষণা করেন।
পরে নিজ কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন জানাবেন কি-না, তা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
রায়ের ফলে এখন সুপ্রিম কোর্ট জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনা আপনি চলে আসবে কি-না- প্রশ্নের জবাবে আপিল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া মাহবুবে আলম বলেন, না, যেটি সংসদ বাতিল করেছে, সেটি আপনা আপনি চলে আসতে পারে না।
বিচারপতি অপসারণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে এখন এক ধরনের শূন্যতার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রায়ের পরে রিট আবেদনকারী আইনজীবীদের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছেন, এখন বিচারক অপসারণ আগের পদ্ধতিতে সুপ্রিম কোর্ট জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে হবে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ লোক প্রাণ দিয়েছেন এবং দুই লাখ মা-বোন তাদের ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই সংবিধান রক্তের আখরে লেখা’।
‘আমাদের স্বপ্ন সংবিধানের মূল ধারায় ফিরে যাওয়া। এবং এই ধারাগুলোতে আমরা ফিরেও গিয়েছিলাম পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলার রায়ের মাধ্যমে। কিন্তু আমি অত্যন্ত হতাশ। আজকের এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের যে আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল, সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ ৯৬- এ ফিরে যাবো, সেটি আর হলো না। আমি অত্যন্ত দু:খ অনুভব করছি’।
আদালতের রায়ের ফলে বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরে এলো কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মতে পুনর্বহাল হয়নি। আমার মতে, সংবিধানের যে অনুচ্ছেদ সংসদ বাতিল করেছে, সেটি আপনা আপনি রেস্টর (পুন:স্থাপন) হবে না। এ অবস্থায় আমার মতে শূন্যতা বিরাজ করছে। সংসদের কাজ তো আর আদালত করতে পারেন না’।
এ রায়ের ফলে সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে গেল কি-না- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘দ্বন্দ্বের কথা আমি বলবো না। আমার কথা হলো, আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল যে, আমরা মূল সংবিধানে ফিরে যাবো। যে সংবিধান আমরা রক্তের বিনিময়ে পেয়েছিলাম। যেটিকে বঙ্গবন্ধু রক্তের আখরে লেখা বলেছিলেন। এখানেই আমার হতাশা’।
এ রায়ের পর এখন আপনারা কি করবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরকারের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে হাইকোর্ট রায়ে যে সমস্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা ছিল খুবই আপত্তিকর। তা বাদ দেওয়া উচিত’।
সকাল নয়টায় আদালত বসার কথা। সেখানে প্রায় ৮৫ মিনিট দেরি করে কেন বসলেন- জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘বিচারপতিরা হয়তো ভেতরে এটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন। এটি অনেক মামলার ব্যাপারেই হয়।
সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে এ রায়ের কোনো প্রভাব পড়বে কি-না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার তো চলে শাসনতন্ত্র মেনে। এখন দেখা যাক বিচারপতিদের অপসারনের ব্যাপারে কি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
সংবিধানতো পরিবর্তনশীল, বিভিন্ন সময়ে সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে আপনারা এতো হতাশ হচ্ছেন কেন?- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘হতাশ এজন্য যে, এটাতো পরিবর্তনের প্রশ্ন না। এটা হলো আগের জায়গায় যাওয়া, পুন:স্থাপন করা । তার চেয়ে বড় কথা, সুপ্রিম জুডিশিয়ালের বিষয়টি। যা একমাত্র পাকিস্তান আর আমাদের দেশে সামরিক সরকার এসে জিয়াউর রহমানের আমলে অন্যায়ভাবে সংবিধান সংশোধন করেছিল। কাজেই আমাদের কথা হলো, আমরা সংবিধান থেকে সামরিক শাসনে যা করেছিল, সেগুলোকে মুছে ফেলতে চাই’।
মূল সংবিধানে ফিরে যেতে পারলেন না তাতে কি ক্ষতি হলো- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, এটি একটি প্রক্রিয়া। বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে সংসদে বা সংবিধানে যেটা আছে, সেখানে ফিরে যাওয়া- এটি সবারই প্রত্যাশা। পৃথিবীর কোনো দেশেই কিন্তু মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে বাধা সৃষ্টি হয়নি। পঞ্চদশ সংশোধনীতে এ বিষয়টি শুধু কাটিং অ্যান্ড পেস্ট করা হয়েছে। বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি’।
‘ষোড়শ সংশোধনীতে আইনমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন- কেন আমরা ৯৬ অনুচ্ছেদে ফিরে যেতে চাই। আগের সংশোধনীতে মূল সংবিধানকে পরিবর্তন করা হয়েছিল, এটি হলো মূল সংবিধানে আমরা ফিরে যেতে চাই। তফাৎটা হলো সেখানে। এটি বুঝতে হবে’।
তিনি বলেন, ‘৫ম, ৭ম, ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে আমরা মূল সংবিধানে ফিরে গেছি। আর এ সংশোধনী আনা হয়েছিল মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য, সেটি ব্যহত হলো। বঙ্গবন্ধুর আমলে যেটি ছিল, সেটি হলো, সিস্টেম পরিবর্তন করা হয়েছিল। মূল যে বিষয়গুলো সেগুলো মৌলিক অধিকার। এগুলোতে কোনো পরিবর্তন হয় না’।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়।
সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ০৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ০৯ নভেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলের শুনানি শেষে গত বছরের ০৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।
এর বিরুদ্ধে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৭
ইএস/এএসআর