সোমবার (৩১ জুলাই) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক সভায় এ মন্তব্য করেন তিনি। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির পরিচিতি সভা ও কর্মী সমাবেশের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ।
সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ আইনজীবী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ওনারা (সুপ্রিম কোর্ট) মাসদার হোসেন কেসে ডিসিপ্লিনারি রুলসের কথা বলেছেন। কেউ কিন্তু ডিসিপ্লিনারি রুলস করে নাই। আমি আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরে এ রুলসটা করে, যেহেতু ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে (হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকিবে) যে হাইকোর্ট, নট দি অ্যাপিলেট ডিভিশন...। তাদের জানানোর জন্য এটা (রুলস) তাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম।
‘তারা (সুপ্রিম কোর্ট) সংশোধন করে যেটা দিয়েছিলেন সেখানে দেখা গিয়েছে, আমার কাছে ডকুমেন্ট আছে, ১১৬ অনুচ্ছেদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা সেটা তারা নিয়ে নিতে চায়। আমি কী করে সেটা দেই? আপনারা আমাকে রায় দিয়ে দেন, বলেন? আমি তো দিতে পারি না। ’
আনিসুল হক আরও বলেন, ‘আমি বললাম আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আসেন শেষ করে দেই। আমি একটা ড্রাফট পাঠিয়েছি। আপনারা কারেকশন করে দিয়েছেন। আমরা সেটার ওপরে সেইটুকু হাত লাগিয়েছি। যেইখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ১১৬ অনুচ্ছেদ (বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে) মতে, সেইটা আমি শুধু বলেছি- না, এটা দেওয়া যাবে না। ওটা ফেরত পাঠিয়েছেন। ’
‘আমি তো এসে ওনাকে (প্রধান বিচারপতি) দিয়েছি। আমি তো এমন না পিয়ন বা আমার সচিবকে দিয়ে ওনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি এসে ওনাকে দিয়েছি। বলেছি আপনি পড়েন আপনি দেখেন। তার পরে যদি কোনো বক্তব্য থাকে আমাকে জানান। তারপরেও আলোচনা করবো। তিনি এজলাসে উঠে বললেন, যে হাইকোর্ট টা তাহলে উঠিয়ে দেন! হাইকোর্ট তো বঙ্গবন্ধু করে দিয়ে গেছেন। আমরা কী করে উঠাই দিবো। তাহলে এ কথা কি অপ্রাসঙ্গিক না? তিনি প্রধান বিচারপতি। আমার তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান আছে। আমি সেই সম্মান ও অধিকার রেখে প্রধান বিচারপতিকে বলতে চাই, আমি তো হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্ট উঠানোর কথা বলি নাই। ডিসিপ্লিনারি রুলস দিয়ে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্ট ওঠে না। আপনার এজলাসে বসে এগুলি বলার তো দরকার হয় না। আলাপ আলোচনা তো আমি করবোই। আমি কালকে যশোরে ছিলাম। ওনার কথা শুনে আমি ফোন করে বলেছি আমি আসতেছি বৃহস্পতিবারে বসবো। আমাদের সদিচ্ছা আছে। ’
১৯৯৯ সালের ০২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেনের মামলায় (বিচার বিভাগ পৃথককরণ) ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেওয়া হয়। ওই রায়ের ভিত্তিতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। আপিল বিভাগের এ নির্দেশনার পর গত বছরের ০৭ মে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধি প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।
গত বছরের ২৮ আগস্ট শুনানিকালে আপিল বিভাগ খসড়ার বিষয়ে বলেন, শৃঙ্খলা বিধিমালা সংক্রান্ত সরকারের খসড়াটি ছিলো ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ। যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি।
এরপরই সুপ্রিম কোর্ট একটি খসড়া বিধিমালা করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। গত ১৬ জুলাই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এ সংক্রান্ত গেজেট শিগগিরই প্রস্তুত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন আইনমন্ত্রী। পরবর্তীতে ফের ২৭ জুলাই বিকেলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খসড়াটি হস্তান্তর করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সাক্ষাতের পর আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিধিমালার খসড়া প্রধান বিচারপতির কাছে হস্তান্তর করেছি। এটি এখন তিনি দেখবেন। পরে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর এটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।
কিন্তু রোববার (৩০ জুলাই) সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির বেঞ্চ আইনমন্ত্রীর দেওয়া খসড়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হলো। তিনি খসড়া দিয়ে গেলেন। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম। যদিও খুলে দেখিনি। কিন্তু এটা কী! এখানে বলা হলো ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’। এটার মানে কী? সব আইনে ব্যাখ্যা থাকে। কিন্তু এখানে কোনো ব্যাখ্যা নেই।
অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে আপিল বিভাগ বলেন, খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত তারিখে বিধিমালার গেজেট কার্যকর হবে। অথচ মাসদার হোসেন মামলার রায়ে আদালত বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে পরামর্শ মোতাবেক গেজেট হবে। আমরা যেটা বলেছি তার উল্টোটা খসড়া করে পাঠিয়েছেন। রায়ের ১৬ বছরে এটা হয়নি। আর সরকার নির্ধারিত তারিখে গেজেট হলে ১৬শ’ বছরেও এটা হবে না!
আপিল বিভাগ আরও বলেন, এখানে বলা হলো কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত হবে। তাহলে হাইকোর্টের কী থাকলো? সব মন্ত্রণালয়ের। ১৮৬১ সালে কলকাতা হাইকোর্ট হয়েছে। তখন থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকরা নিম্ন আদালত পরিদর্শন করেন। এ ব্যবস্থা চলে আসছে। হাইকোর্ট কেন রাখবেন। হাইকোর্ট উঠিয়ে দেন। ... এখনতো কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির কোনো ক্ষমতা নেই।
অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম আইনমন্ত্রী আসায়। খসড়া দিয়ে যান তিনি। প্রেসে বক্তব্য দিয়েছেন হয়ে গেছে। কিন্তু কী রকম হলো।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি বিদেশ যাওয়ার সময় মন্ত্রণালয় জিও দেয়। জবাবে আদালত বলেন, আপনি তাহলে অ্যাভয়েড করছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, না। আদালত বলেন, তিনি (আইনমন্ত্রী) এখান থেকে যাওয়ার পর কম্প্লিটলি ইউটার্ন দেখলাম।
আদালত বলেন, রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুপুর ২টা থেকে আমি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিরা রাত ১২টা পর্যন্ত আপনাদের (সরকার) সময় দেবো। বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা নিয়ে আর রশি টানাটানি নয়। আইনমন্ত্রীসহ সরকারের যেকোনো এক্সপার্ট আসবেন, বৈঠকে বসবো।
পরে আদালত আদেশের জন্য ৬ আগস্ট নির্ধারণ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ২২২৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩১,২০১৭
ইএস/এমজেএফ