রায়কে কেন্দ্র করে এদিন সকাল থেকেই আদালত এলাকায় ছিল বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
আদালতে হলি আর্টিজান মামলার আসামিরা
এদিন সকাল ১০টার দিকে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয় আসামিদের। গাজিপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তায় তাদের নিয়ে এসে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়।
প্রস্তুত আদালত, প্রস্তুত গণমাধ্যম
এদিকে দিনের কার্যক্রম শুরুর প্রাথমিক পর্যায়েই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখে আদালত কর্তৃপক্ষ। প্রস্তুত ছিলেন গণমাধ্যম কর্মীরাও। দেশিয় প্রেক্ষাপট তো বটেই, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও ন্যাক্কারজনক এই হামলার মামলার রায় নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে প্রস্তুত ছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরাও। দুষ্টের দমনে দেশিয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ছিল সরব উপস্থিতি।
এজলাসে হলি আর্টিজান মামলার আসামিরা
মামলার রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর ১২টা। এজন্য সকাল সাড়ে এগারোটার কিছু পরে আসামিদের তোলা হয় ঢাকা সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের এজলাসে। হাজতখানা থেকে একে একে বের করে আনা হয় অভিযুক্ত আট আসামিকে। এসময় হাসিমুখে এবং অনেকটা ঔদ্ধত্য আচরণেই আদালতের দিকে যেতে দেখা যায় আসামিদের। এই আচরণ অব্যাহত থাকে রায় ঘোষণার পরও। আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে নিয়ে আসার পুরোটা সময়ে আসামিদের দম্ভ নিয়ে বক্তব্য দিতে শোনা যায়।
হলি আর্টিজান মামলায় ৭ আসামির মৃত্যুদণ্ড, একজন খালাস
আনুমানিক ১২টা ৫ মিনিটের দিকে এজলাসে ওঠেন বিচারক মো. মজিবুর রহমান। প্রায় ১০ মিনিট সময় নিয়ে রায়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণী পড়ে শোনান বিচারক। এতে অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে সাত জনের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাস বিরোধী আইন এর ৬/২ ধারায় অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এতে ওই সাত আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ। অপরদিকে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান।
রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের সন্তোষ, হবে আপিলও
এদিকে রায় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। তবে মিজানুর রহমানের খালাসের বিষয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানান তারা। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বাংলানিউজকে বলেন, মিজানের বিরুদ্ধে তদন্তে প্রাপ্ত যাবতীয় সাক্ষ্য প্রমাণ আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি। আদালত কী বিবেচনায় তাকে খালাস দিয়েছেন সেটা রায়ের কপি না দেখে বলতে পারবো না। রায়ের কপি দেখে পর্যালোচনা করে তার খালাসের দণ্ডের বিষয়ে আপিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিন রায়ের পাশাপাশি আরেকটি বিষয় সবার নজড় ও মনযোগ কাড়ে। সেটি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশের মাথায় জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর প্রতীক সম্বলিত টুপি। আদালত ভবনের পাঁচতলার এজলাস থেকে লিফটে নামার সময় আসামি আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশের মাথায় জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর প্রতীক সম্বলিত টুপি দেখা যায়। তবে কেউ কেউ বলছেন, এই টুপি তিনি এজলাসে থাকতেই পরেছেন। পরে প্রিজনভ্যানের মধ্যে আরেক আসামি রাজীব গান্ধীর মাথায়ও একই টুপি দেখা যায়। গাজীপুরের কাশিমপুরের কারাগারের মতো একটি বিশেষ কারাগার এবং আদালত চত্ত্বরের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই এই টুপি আসামিদের হাতে কীভাবে পৌঁছালো সেটিই অবাক করে দেয় সবাইকে।
এই টুপির রহস্য উদঘাটনে ইতোমধ্যে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছেন আইজি প্রিজন ব্রি. জে. মোস্তফা কামাল পাশা। তদন্তের কথা জানিয়েছেন ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামও।
ক্ষত পূরণে সাহায্য করবে এই রায়: এসি রবিউলের ভাই
এদিকে এই রায় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সেই হামলার ঘটনায় নিহতের স্বজনেরা। হারিয়ে যাওয়াকে ফিরিয়ে না দিলেও এই রায় মনের ক্ষত পূরণে সাহায্য করবে বলে নিজ প্রতিক্রিয়ায় জানান জঙ্গিদের হামলায় নিহত পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামের ভাই শামসুজ্জামান শামস। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হামলায় নিহত আরেক পুলিশ কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীনের দুই ভাই। সেসময়ে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ওসি সালাহউদ্দীনই ছিলেন হামলায় নিহত প্রথম পুলিশ সদস্য। নিহতের বড় ভাই রাজি উদ্দিন খান ও ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী খান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ঘটনায় আটকেপড়াদের উদ্ধার করতে যান আমাদের ভাই বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাউদ্দিন খান। জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডে আমাদের ভাই নিহত হন। আমরা ন্যায্য বিচারের আশায় দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলাম।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে রায় কার্যকরের অপেক্ষায় পুরো জাতি। যদিও আইনি পথে আছে বেশকিছু আনুষ্ঠানিকতা। নিয়ম অনুযায়ী, মৃত্যু দণ্ডাদেশ অর্থ্যাৎ ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হবে উচ্চ আদালতে অনুমোদনের জন্য। মামলার সব নথি আসা এবং আপিলের (যদি আসামিরা আপিল করেন) পর তৈরি করতে হবে পেপারবুক। আপিল পিটিশন দায়ের করা হলে শুরু হবে আপিলের শুনানি। এরপর থাকবে রিভিউয়ের সুযোগ।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির (আত্মঘাতী) সদস্যরা। তাদের গুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গি।
ওই ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন ওই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাস। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ১ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন।
একই বছরের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান।
এক বছরের বিচারকালে মামলার মোট ২১১ জন সাক্ষীর ১১৩ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন এবং রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে গত ১৭ নভেম্বর এ মামলার বিচারকাজ শেষ হয়। ওইদিনই আদালত রায় ঘোষণার জন্য ২৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।
আরও পড়ুন>>
**আদালতে হলি আর্টিজান মামলার আসামিরা
**হলি আর্টিজানে হামলার পর বদলে গেছে গুলশানের নিরাপত্তা
**গুলশান হামলা: আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি পরিবারের
**‘দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতেই হলি আর্টিজানে হামলা’
**যেভাবে সফল হয় ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’
**এখন যেমন গুলশানের সেই হলি আর্টিজান বেকারি
**এজলাসে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত, থাকবেন বিদেশি পর্যবেক্ষক
**আদালত এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা
**আদালত এলাকায় উৎসুক জনতার ভিড়
**আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা চান সাধারণ মানুষ
**হলি আর্টিজান হামলার ‘নীল নকশা’
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৯
এজেডএস/পিএম/কেআই/টিএম/এসএইচএস/এএ/এসএইচএস/এইচএডি/