তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, থানায় নতুন নেতৃত্বকে আসতে দিতে চান না বয়সের ভারে ন্যুব্জপ্রায় (আশি উর্ধ্ব) নেতা মুহা: ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক। তিনি মন্ত্রী হলেও তার হয়ে এখানকার সব কার্যক্রম পরিচালনা করেন পাঁচ ব্যক্তি।
এরা হলেন- থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি এমদাদুল হক মোল্লা, সেক্রেটারি সর্দার জসীম উদ্দীন, সভাপতির ছেলে মহিদুল হক বাদশা, যুবলীগ নেতা কামরুল ইসলাম পাশা প্রমুখ। পুরো আসনেই এই চক্রের রয়েছে বিশেষ বাহিনী। তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন এখানকার সব হাট, ঘাট, বাজার, খাদ্য গুদাম, চালকল সিন্ডিকেট। সরকারি চাকরির তদবির, মামলা মোকদ্দমা শালিস সবই দখলে রেখেছে এই চক্র।
সাধারণত বর্ষীয়ান রাজনীতিক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী মুহা: ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিকের এক সময় তৃণমূলে জনপ্রিয়তা ছিল আকাশ চুম্বী। নওগাঁ-৪ আসনের মান্দা উপজেলার আনাচে কানাচে ছিল তার সমান যাতায়াত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিতেও ছিল সমান গ্রহণযোগ্যতা। থানা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এর আগে তিনি ১৯৭০ এর প্রাদেশিক নির্বাচন, ১৯৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন। তবে এরশাদ পরবর্তী আমলের তিন নির্বাচনে ’৯১, ’৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি পরাজিত হন বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থীর কাছে। ফলে ২০০৮ সালে দল থেকে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন তিনি। এ সময় দলের মনোনয়ন পান থানা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহ-সভাপতি আব্দুল লতিফ শেখ। তবে কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক। দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নবম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি প্রার্থী শামসুল আলম প্রামাণিককে পরাজিত করেন। এরপর আওয়ামী লীগ আবার দলে ফিরিয়ে নেয় ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিককে।
নবম সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই তার কাটে বর্ষীয়ান এ নেতার। দলে অবস্থান ধরে রাখতে তিনি আস্থা রাখেন থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি এমদাদুল হক মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক সর্দার জসীম উদ্দীনের ওপর। এ দুই নেতা ও তাদের পরিবার শুরু করেন বর্ষীয়ান ইমাজ উদ্দিনের নাম ব্যবহার। সঙ্গে যোগ হয় এমপির নিজের আত্মীয়রা।
এই চক্র নিজেদের প্রতাপ ধরে রাখতে দলে তৈরি করে দলীয় কোন্দল। এমপির কাছের মানুষের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় দূরে সরিয়ে দেওয়া হয় ত্যাগী নেতা-কর্মীদের।
থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সেক্রেটারির পদ হারানোর ভয়ে এমপির নির্দেশনায় বন্ধ করা হয় থানা আওয়ামী লীগের নিয়মিত কাউন্সিল। ফলে ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ পদে আছেন এমপির পরীক্ষিত দুই অনুচর এমদাদুল হক মোল্লা ও সর্দার জসীম। এদের ভয়ে মুখ খোলে না আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
অভিযোগ আছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এ আসনে প্রার্থী হতে মনোনয়ন চেয়েছিলেন বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ব্রহানী সুলতান মাহমুদ গামাসহ আটজন। বিএনপি জোট নির্বাচনে না আসায় দলীয় মনোনয়ন পান ইমাজ উদ্দিন। ৫ জানুয়ারির এ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই মনোনয়ন চাওয়া স্থানীয় নেতাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেন তিনি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাস পর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন পান গামা। দলের এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি বর্তমান সংসদ সদস্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান তারই অনুগত থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সর্দার জসীমকে।
আওয়ামী লীগের এই কোন্দলে গামার চেয়ে ৫৫৬ ভোট বেশী পেয়ে নির্বাচিত হন থানা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আব্দুর রশীদ। এই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী চৌধুরী মখলেসুর রহমান পান তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট। চতুর্থ স্থানে থাকেন মন্ত্রীর প্রার্থী জসীম।
স্থানীয়দের অভিযাগ, ১২৫ কেন্দ্রের মধ্যে ৯০ কেন্দ্রের ভোট গণনায় ১০ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়েছিলেন গামা। কিন্তু এরপরই মন্ত্রীর নির্দেশনায় ভোট গণনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঘোষিত ফলাফলে পরাজয় হয় গামার। ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, কোন প্রার্থী না থাকলেও চিংড়ী প্রতীক ভোট পায় আট হাজার।
এই নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী মান্দা থানা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও জেলা কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক ব্রহানী সুলতান মাহমুদ গামা এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, এমপির তত্ত্বাবধানেই বিএনপির প্রার্থী থাকার পরও জামায়াত প্রার্থী নির্বাচিত হয়। থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েও যখন আমাকে ঠেকাতে পারছিলেন না, তখন ভালো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা বলে আমাকে পরাজিত করেন মন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন।
থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম বলেন, এই উপজেলায় জামায়াতের ভোট মাত্র ২০ হাজার। কিন্তু দলীয় কোন্দল ও এলাকার উন্নয়ন না হওয়ায় উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হয়। এই কোন্দলের কারণও মন্ত্রী ইমাজ। তিনি থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অন্ধ বিশ্বাস করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, মে ৩১, ২-১৭
আরএম/জেডএম