বর্ষীয়ান এ রাজনীতিকের রাজনৈতিক খায়েশ পূরণ আর নিষ্ক্রিয়তায় দারিদ্রপীড়িত এই উপজেলায় এরই মধ্যে একবার হাতছাড়াও হয়েছে নৌকার জয়। সেটা ২০১৪ সালে।
নেতাকর্মীদের সব অভিযোগ বর্তমান সংসদ সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিক, থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি এমদাদুল হক মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক সর্দার জসীম উদ্দীন গংদের বিরুদ্ধে। তারা জনবিচ্ছিন্ন, তারা দলীয় কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় করে দলকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে রেখেছেন--এমন অভিযোগ নেতাকর্মীদের।
তৃণমূলের নেতাকর্মী, ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই চিত্র। তাদের অভিমত, এই আসন ধরে রাখতে এবার কেন্দ্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য দরকার প্রার্থী বাছাইয়ে মনোযোগী হয়ে তৃণমূলের চাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া। জনবিচ্ছিন্ন ও বয়সের ভারে ন্যূব্জ বর্তমান এমপি পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিককে বাদ দিয়ে বাছাই করতে হবে নতুন প্রার্থী। নির্বাচন থেকে দুরে রাখতে হবে দুর্নীতিপরায়ণ স্থানীয় নেতাদের। দূর করতে হবে দলের অন্তর্কোন্দল। ২০০৫ সালের পর আর কাউন্সিল না হওয়ায় সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়া থানা আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে দাঁড় করাতে হবে শক্তি হিসেবে। সেই তাড়না থেকে স্থানীয় ভাবেই হচ্ছে নতুন প্রার্থীতালিকা। এখন পর্যন্ত যাদের নাম শোনা যাচ্ছে নতুন প্রার্থী হিসেবে তারাও নিশ্চিত নন আসন্ন নির্বাচনে আসনটি বাঁচানো যাবে কিনা। নৌকা প্রতীকে মনোনয়নের জন্য যারা এখনই জনসংযোগে নেমে মাঠ গোছানোর কাজ করছেন তারা হলেন মান্দা থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা কমিটির সাংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক এস এম ব্রহানী সুলতান মাহমুদ গামা, থানা সহ-সভাপতি আব্দুল লতিফ শেখ, স্বাচিপ নেতা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা: আব্দুর রহমান, থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম, সাবেক পিপি (নারী ও শিশু) আব্দুল বাকি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং কুতুববাগ দরবার শরীফের কমান্ডার মির্জা মাহবুব বাচ্চু।
তবে তৃণমূলের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছেন উপজেলা নির্বাচনে মাত্র ৫৫৬ ভোটে কথিত ‘দলীয় ষড়যন্ত্রে পরাজিত’ প্রার্থী ব্রহানী এসএম সুলতান মাহমুদ গামা ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের ডা: আব্দুর রহমান।
স্থানীয়দের মতে ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান সংসদ সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিকের কোনো আর্থিক কেলেংকারি নেই। তবে মান্দা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমদাদুল হক মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক সর্দার জসীম উদ্দীন গংদের বিরুদ্ধে অব্যাহত দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম, নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, হাট-বাজার, ঘাটের দখল, সরকারি খাদ্য গুদামের দখল, মন্ত্রীর এলাকায় না আসা ও জন বিচ্ছিন্নতা, মন্ত্রী থাকার পরও এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা না রাখাসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এসবই কাল হতে পারে বর্ষীয়ান এই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিকের।
তবে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, গত উপজেলা নির্বাচনে তিনি দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সর্দার জসীম উদ্দীনকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। একই সঙ্গে দলের নেতৃত্ব এবং এ আসন কুক্ষিগত করে রাখতে মন্ত্রী ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিক একযুগের বেশি সময় ধরে আটকে রেখেছেন থানা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। ফলে এই দীর্ঘ সময়টা থানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আঁকড়ে আছেন ইমাজ প্রামাণিকের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত এমদাদুল হক মোল্লা ও জসীম মন্ডল। এর ফলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। সংগঠন হিসেবে শক্তি হারিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
এক সময়ে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল মান্দা উপজেলার। এ আসনে বিএনপির পরাক্রমশালী নেতা ছিলেন শামসুল আলম প্রামাণিক। কিন্তু ২০০৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন বর্তমান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ প্রামাণিক। ওই নির্বাচনে তার কাছে পরাজিত হন শামসুল আলম প্রামাণিক। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও সে সময়ের থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ শেখ তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান। পরে ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিক আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলত্যাগ করে জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) প্রার্থী সাইদুর রহমান বকুলকে পরাজিত করেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ব্রহানী সুলতান মাহমুদ গামা বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন ও এর পরের এক বছর পর্যন্ত এখানে দল ভালোভাবেই চলছিল। এরপর থেকে সংগঠন আর সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নেই। মন্ত্রী মহোদয় কেবল সভাপতি ও সেক্রেটারি এবং কিছু আত্মীয়স্বজন ও তাদের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে দল পরিচালনা করছেন। সবাই তাদের সুবিধা নিয়ে আছেন। থানা কমিটির অন্য কারো সঙ্গে মন্ত্রীর বৈঠকের প্রয়োজন হয় না। ১২ বছর ধরে কাউন্সিল দেয়া হচ্ছে না। ২০১০ সালের পর থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক কর্মী সভা হয়নি। এতে তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তার সুবিধা নিয়ে অনেকেই টাকার মালিক হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে তার কিছু সুবিধাভোগী আছে। অথচ দলের ত্যাগী নেতাদের কোনো দাম নেই। কেবল তার চাওয়াতেই উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে।
মন্ত্রী প্রামাণিকের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলে সুলতান মাহমুদ গামা আরও বলেন, এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জেতার কথা নয়। কারণ নির্বাচনে কেবল মার্কা নয়, প্রার্থী ও একটা ফ্যাক্টর। এ আসন পেতে হলে হয় নতুন প্রার্থী আনতে হবে, নতুবা নেত্রীকে প্রার্থী হতে হবে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা স্বাচিপ নেতা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা: আব্দুর রহমান বলেন, আসন ধরে রাখতে হলে অবশ্যই কেন্দ্রকে প্রার্থী বাছাইয়ে নতুনত্ব আনতে হবে। , তৃণমূলের চাওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে। দলকে একতাবদ্ধ করতে হবে। কারণ দলকে এখন আর ইউনাইটেড বলা যাবে না। এর মূল কারণ থানা পর্যায়ে এখন সাংগঠনিক কার্যক্রম নাই। এজন্য কাউন্সিল দেয়া জরুরি। যে কমিটি ১২ বছর ধরে আছে তার পেছনে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। নিশ্চয়ই অর্থনৈতিক কারণই এর পেছনে দায়ী। তবে সকল ইউনিয়ন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জোটবদ্ধভাবে দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি কাউন্সিল দেওয়ার জন্য চিঠিও দিয়েছেন। কিন্তু অজানা কারণে তা ঝুলে আছে।
অন্যেদিকে থানা আওয়ামী লীগের আর এক সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রী এলাকায় কম আসেন। দলে কোন্দল চরমে পৌঁছেছে। দলের পুরোনো লোক খাতের মাঝি, রামজীবন মৈত্র, মোজাহারুল আনোয়ার, অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান, নাজিম মন্ডলের মতো মূল আওয়ামী লীগাররা এখন দূরে আছেন। মন্ত্রীর ওপর তারা কোনো কারণে ক্ষুব্ধ। তাই বলা যায়, এই আসনে আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো না। বিএনপি ও জামায়াত যদি জোটবদ্ধ নির্বাচন করে তবে আসন রাখা কঠিন হবে। এজন্য নতুন প্রার্থী, নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন। মন্ত্রীর উচিত হবে সম্মানের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ইতি টানা।
** নওগাঁ-৪: ইমাজের ইমেজ নষ্ট পাঁচ পাণ্ডবে
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৪ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৭
আরএম/জেএম