ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে তিতাস নদী। আর তার বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে, এক সময়ের প্রতাপশালী জমিদার গৌর প্রসাদ রায় চৌধুরীর সুরম্য প্রসাদ ‘বড়বাড়ি’।
‘বড়বাড়ি’ নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, বাড়িটির বিশালতার কারণেই তৎকালীন জমিদাররা ‘বড়বাড়ি’ নামকরণ করেন।
নদীর তীর থেকেই সোজাসোজিভাবে উঠেছে বাড়ির দক্ষিণের শান বাঁধানো পুরনো ঘাট। ঘাটে লোকজনের উপস্থিতি দেখে মনে হতে পারে, এখনো জমিদারের লোকজন বসবাস করেন। দক্ষিণের এঘাট দিয়েই মূলত বাড়িতে ঢুকতে হয়। অনেক বড় বারান্দা ডিঙিয়ে মূল বাড়িতে প্রবেশ। প্রথম দর্শনে স্মৃতিকাতর হয়ে যেতে পারেন অনেকই!
তবে অযত্ন আর অবহেলা এবং স্থানীয় দখলদারদের নির্মমতায় তিতাসের মতোই হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন এ স্থাপত্যটি।
জানা যায়, এক সময়ের প্রতাপশালী জমিদার গৌর প্রসাদ রায় চৌধুরী তার পরিবার নিয়ে থাকতেন এখানে। প্রভাব-প্রতিপত্তিও কম ছিলনা তার। সড়কের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নাসিরনগরের হরিপুর ‘বড়বাড়ি’ কালের আবর্তে এখন ধ্বংসের কাছাকাছি। কিন্তু প্রায় ৫শ বছরের পুরনো এই বাড়ির অবকাঠামো এখনো ভাবনায় ফেলে দেয় দর্শনার্থীদের।
কৃষ্ণ প্রসাদ চৌধুরী, হরেন্দ্র লাল চৌধুরী, হরিপদ রায় চৌধুরী ছিলেন গৌর প্রসাদ রায় চৌধুরীর বংশধর। তবে তাদের বংশধররা কবে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, এর সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি কারো কাছ থেকে। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, বাড়িটি প্রায় ৫শ বছরের পুরনো।
বাড়ির উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই চোখে পড়ে কারুকাজখচিত দেওয়াল। দ্বিতল বিশিষ্ট এ বাড়ির কয়েকটি ঘরকে মন্দির ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এর পশ্চিম পাশে উঁকি দিলে যে কেউ বলতে বাধ্য হন যে, এই না হলে ‘বড়বাড়ি’! সবমিলিয়ে শতাধিক কক্ষ নিয়ে বড় বাড়ির অবস্থান। বাড়ির একপ্রান্তে খেলার মাঠ, আরেক প্রান্তে ‘মহল পুকুর’।
চুন-সুড়কিতেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এই বাড়ি। একেকটি আঁড়া দুই থেকে আড়াই ফুট চওড়া। সব মিলিয়ে ৪ দিক দিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি। আছে রঙ্গমঞ্চ, নাটমন্দির, শয়নকক্ষ ইত্যাদি।
তবে দর্শনার্থীদের চোখ আটকায় সেখানকার বস্তির মতো পরিবেশ দেখে। ৩০টির মতো পরিবার অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সেখানে বসবাস করছে। বসবাসকারীরা জানালেন, খালি পড়ে থাকায় অন্তত ৩০টি পরিবার ১০ থেকে ৭০ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। সামনের অংশের সীমানা প্রাচীর ভেঙে মাটিতে মেশার উপক্রম। একটি কক্ষেরও পুরনো দরজা নেই। বর্তমানে বসবাসকারীরা সাধারণ মানের দরজা লাগিয়ে থাকছেন।
বড়বাড়ির পুরোহিত আশীষ চক্রবর্তী বংশপরম্পরায় থাকেন এ বাড়িতে। তিনি জানালেন, তার দাদা ছিলেন এ জমিদার বাড়ির পুরোহিত ছিলেন। সেই সূত্রে প্রায় ৭০ বছর ধরেই এখানে তাদের থাকা। বাপ-দাদা নেই। তাই, তিনিই এখানে পূজা অর্চনার কাজ করেন। বাড়ির ছোট্ট উঠোনে থাকা কারুকাজ খচিত তুলসী বেদিতে নিয়মিত পূজা দেওয়া হয়।
আশীষ চক্রবর্তী বাংলানিউজকে জানান, গৌর প্রসাদ রায় চৌধুরীর এ বাড়িটি এক দুন অর্থাৎ ১৬ কানি জায়গা নিয়ে অবস্থিত। কয়েক বছর আগে তার এক বংশধর কলকাতা থেকে এসে ঘুরে গেছেন। বাংলাদেশে তার বংশধর আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। নাম বিমল রায়। তিনি ইতোমধ্যে নিজের অংশের জায়গাটুকু (খালি জায়গা) বিক্রি করে দিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানালেন, এখানে স্যুটিং করতে প্রায়ই সিনেমা, নাটকের দল আসে। বেশ কয়েকবছর আগে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত শেষছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র স্যুটিং হয়েছে এখানে।
একবার এমনই একটি দল তাদের প্রয়োজনে বাড়িটির কিছু অংশে রং করেন। তবে এমনিতে বাড়িটিতে সংষ্কারের ছোঁয়া লাগেনি। দিনকে দিন বাড়িটির সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক পর্যটক এসে আফসোস করেন। বিশেষ করে শীতকালে এখানে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় থাকে।
হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘বড়বাড়ি আমাদের ঐতিহ্যের বাহক। বহু-মানুষজন বাড়িটি দেখতে আসেন। ২০০৫ সালের দিকে একবার বাড়িটি সংষ্কারের জন্য গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু, পরে তাতে আর সাড়া পাওয়া যায়নি। বাড়িটি সংস্কার করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানান তিনি।
নাসিরনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোজ্জামেল হক বাংলানিউজকে জানান, নাসিরনগরের হরিপুর বড়বাড়ি এখানকার ঐতিহ্য! বাড়িটি সংষ্কার করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১২
সম্পাদনা: শামীম হোসেন, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর