নিউইয়র্ক: এক স্বপ্নহীনের অনেক স্বপ্নপূরণের গল্প শুনতে হলে পার্কচেস্টারের জাকির খানের কাছে যেতে হবে। আপনার স্বপ্ন কি? এই প্রশ্নে তার নির্লিপ্ত উত্তর স্বপ্ন নেই কোনো! স্রেফ সময় কাটিয়ে দিতে পারছি এটাই এখন ভালো লাগে।
কিভাবে সম্ভব হলো? জানতে চাইলে জাকির খান জানালেন ২০১২ সালের ৩০ মার্চ নিউইয়র্কের রাজধানী আলবেনির সিনেটে বাংলাদেশ ডে বিলটি পাশ হওয়ার কথা, যা অনেকেরই জানা।
সিনেটের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশ ডে বিলটি উপস্থাপন করেন নিউইয়র্কের স্টেট সিনেটর রবিন ডিয়াজ। এসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে সিনেটে বক্তৃতা করেন এই সিনেটর। উপস্থাপনের ২০ মিনিটের মধ্যে বিলটি বিপুল ভোটে পাস হয়।
দিনটি ছিলো ভীষণ আনন্দের। এটি ছিলো বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জনের একটি দিন। বিলটি তৈরিতে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্কসের পাকচেস্টারের বর্তমান অ্যাসেমব্লিম্যান লুইস সেপুলভেদা।
এই সিনেটর রবিন দিয়াজ ও লুইস সেপুলভেদা বাঙালি কমিউনিটির সবচেয়ে বড় বন্ধু। আর এই বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয় জাকির খানের মাধ্যমেই। কমিউনিটিতে তাদের পরিচিত করে তুলতে, একই সঙ্গে কমিউনিটির জন্য তাদের বিভিন্ন সহযোগিতা নিতে জাকির খান একটি মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করে আসছেন। তিনি জানালেন, দীর্ঘ পরিচয়ের সূত্র ধরেই, কমিউনিটির বিভিন্ন কাজে তারা পেয়েছেন রবিন দিয়াজকে। নির্বাচনের আগে ফান্ড রেইজিংয়ে তাকে অনেক সহায়তা দিয়েছেন। ব্রঙ্কসে বাংলাদেশিরাও একচ্ছত্রভাবে তার পক্ষে। জাকির খান বলেন, “এরই প্রতিদান হিসেবে আমাদের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমরা কি চাই। তাৎক্ষণিকভাবে ভালো থাকার জন্য অনেক কিছুই চাওয়া যেতো কিন্তু অনেকে ভেবে চিন্তে আমরা চেয়েছিলাম দেশের জন্য একটা কিছু। আমরা তার কাছে চেয়েছিলাম একটি বাংলাদেশ ডে। আমাদের এই প্রত্যাশা তিনি পূরণ করেছেন। ২০১২ সালে গৃহীত হওয়ার পর ২০১৩ সালেও নিউইয়র্ক সিনেটে পালিত হয়েছে বাংলাদেশ ডে। ”
ব্যক্তি জীবনেও একজন সফল ব্যক্তিত্ব জাকির খান। এই দেশে এসে প্রথমেই লেখাপড়ার দিকে মন দেন। শিক্ষার ফাঁকে কাজ করতে শুরু করেন। খাবারের দোকান, কাপড়ের দোকান, কম্পিটার বিক্রির
কাজের পর এক পর্যায়ে শুরু করেন বাড়িঘর বিক্রির কাজ। পরে সেটিই হয়ে যায় স্থায়ী পেশা। এখন নিউইয়র্কে অন্যতম সফল রিয়েল স্টেট ব্রোকার জাকির খান। যার হাতে রচিত হচ্ছে অনেক মানুষের স্বপ্নে আবাস। নিউইয়র্ক টাইমস যাকে উপাধি দিয়েছে ব্রোকার কিং হিসেবে।
১৯৯৩ সালে জাকির খান যখন তার সিলেটের ছোট্ট গ-ি ছেড়ে নিউইয়র্কের মতো বিশাল প্রচ্ছদে নিজের স্বপ্ন আঁকা শুরু করেন তখন শুরুর দিনগুলো মোটেই সুখের ছিলো না। বার্গার কিংয়ের দোকানে বার্গার বানিয়ে আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ ভেজে তার জীবীকা ও লেখাপড়ার খরচ উঠতো। পরে টি-শার্ট, হ্যাট বিক্রি করতেন মেডিসন স্কয়ারে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে। এখন সেই বার্গার কিংয়ের ওপরেই জাকির খানের এখন নিজের অফিস।
নিউইয়র্কের পার্কচেস্টারে জাকির খানের পশ অফিসে বসেই তার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। সুন্দর সবুজে ঘেরা পুরো এলাকাটি আবাসিক। অসাধারণ একটি নেইবারহুড। বাইরে চোখ ফেলেই দেখা যায় স্বপ্নহীন মানুষটির স্বপ্নবোনা চারিদিকে। অনেকেরই স্বপ্নের আবাস এই পার্কচেস্টারে। বছরে প্রায় ২০০ মানুষের আবাস রচিত হয় জাকির খানের মাধ্যমে। কেউ ভাড়া নেন, কেউ কেনেন, কেউবা কেবলই নেন পরামর্শ।
চল্লিশেই এত সাফল্য খুব কম দেখা যায়? পেছনের কারণ জানতে চাইলে জাকির খান বলেন, কঠোর পরিশ্রমই যে কোনো সাফল্যের মূলে।
মিতভাষী, হাসিমুখের ও কিছুটা মুডি জাকির খান বলেই চললেন তার জীবনের গল্প। বললেন, আমি আমার গ-িটিকে খুব বড় কখনোই করি না। পার্কচেস্টার নিয়ে, এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটি নিয়েই কাজ করতে পছন্দ করি। আর সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমি যা পছন্দ করি, যা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি তাই করি।
জাকির খান বলেন, একটি সুন্দর ঘর যে কোনো মানুষেরই স্বপ্ন। যুক্তরাষ্ট্রে এসেও সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চায় প্রতিটি বাংলাদেশি। এই স্বপ্নপূরণের কাজ করতে পারছি, সেটাই আনন্দের।
এটি একটি সেবাও বটে, বলেন জাকির খান। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সেবাটি হচ্ছে মানুষকে আবাসন নিয়ে পরামর্শ দেওয়া। কেউ যখন দুই বা তিন বেডরুমের বাসা ভাড়া করে মর্যাদ বাড়াতে চায়, তখন তাদের বলি সম্ভব হলে এক বেডের বাসা নিয়ে থাকুন। ৫ বছরের মধ্যে আমি আপনাকে একটি বাড়ি কিনিয়ে দিতে পারবো।
পার্কচেস্টারে জাকির খানের ক্লায়েন্টে ঠাসা। সেখানে কমিউনিটিরও একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি। কমিউনিটির যে কোনো ছোটখাটো প্রয়োজনেও তার ডাক পড়ে। মসজিদ, মার্কেট, সড়ক উন্নয়ন সবকিছুতেই তিনি সক্রিয়।
দূর দেশে এলেও সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে নিজের ছোট্টগ্রামটিকে নিজের এলাকাটিকে মন থেকে মুছে ফেলেন না জাকির খান। গ্রামে নিয়মিত কিছু অনুদান পাঠান। দরিদ্রদের খাবার, শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে এই অনুদান ব্যবহৃত হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে দুই ছেলে, এক মেয়ের গর্বিত পিতা জাকির খান এভাবেই তার অনেক স্বপ্ন পূরণ করে চলেছেন। সন্তানরা হয়ে উঠছে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তবে, কোনো স্বপ্ন আছে কি না? সেই প্রশ্নে তার নির্লিপ্ত উত্তর, কোনো স্বপ্ন নেই... এভাবেই জীবনটি পার করে দিতে চাই।