ঢাকা: ব্যাপক প্রচারণা আর আলোড়ন সৃষ্টির মাধ্যমে ভোটদান পদ্ধতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে চালু করা হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা জটিলতায় ইভিএম এখন হিমঘরে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, একদিকে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহায়তা প্রদানে অসহযোগিতা, ইভিএম চালানোর দক্ষ লোকবল না থাকা ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণ এবং সমাধান বের করতে না পারায় বর্তমানে এ নিয়ে কোনো উচ্চবাক্য করছে না কমিশন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এটিএম শামসুল হুদার কমিশন দায়িত্বে থাকার সময় ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ১৩০ টি ইভিএম তৈরি করে দেয়। সেগুলো দিয়েই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় একটি ওয়ার্ডে ভোটগ্রহণ করে ইসি। এরপর বুয়েটের কাছ থেকে আরও ৪শ মেশিন নেয় ইসি। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে আরো ৭শ মেশিন তৈরি করিয়ে নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ইসির কাছে ১,২৩০ টি মেশিন রয়েছে। আর এজন্য ইসিকে ৫ কোটি টাকা গুণতে হয়েছে।
বিগত কমিশনের পরিকল্পনা ছিলো স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ইভিএম ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা অর্জনের পর দশম সংসদ নির্বাচনেই তা ব্যবহার করা হবে। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ছাড়া প্রত্যেক নির্বাচনেই প্রায় এই মেশিনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। নরসিংদী পৌরসভা, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন, রংপুর সিটি নির্বাচন ও রাজশাহী সিটি নির্বাচনের সময় এ যন্ত্রের ত্রুটি দেখা দেওয়ায় ব্যাপক চাপের মুখে পড়তে হয়েছিলো ইসি। রাজশাহী সিটিতে একটি মেশিনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ফল প্রকাশে দেরি হচ্ছিল। সেদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানের নেতৃত্বে একটি দল ইসিতে এসে রাত ২ টা পর্যন্ত বসে থেকে ছিলেন। এছাড়া ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজকে বিএনপি চেয়ারপার্সন নিজেই ফোন করেছিলেন। পরে ইসির যুগ্ম সচিব জেসমিন টুলী পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করলে বিএনপি নেতারা শান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ওই মেশিনটি আর ঠিক করা যায়নি। সেজন্য পরে আবার ব্যালট পেপারে ভোট নিতে হয়েছিলো সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে।
নরসিংদী পৌর নির্বাচনেও একই সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো কমিশনকে। সেই মেশিন এখনো ঠিক করতে পারেনি ইসি।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, যে মেশিন শতভাগ সুরক্ষিত নয়, তা ব্যবহার করা খুব মুশকিল। এছাড়া ইসির সে কারিগরি টিমও নেই যে, কোনো ত্রুটি দেখা দিলে তা সারিয়ে তুলতে পারবে। তাই কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না কমিশন।
উপ-সচিব পর্যায়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেছেন, আসলে এত বড় একটা পরিকল্পনা বিগত কমিশন হাতে নিলেও আঁটঘাট বেঁধে নামেননি তারা। যেহেতু এটা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই বিগত কমিশনের উচিত ছিলো এই যন্ত্রের ওপর ইসির নিজস্ব একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা।
কিন্তু অপারেটর ছাড়া ইসি কর্মকর্তারা এ মেশিন সম্পর্কে আর কিছুই জানেন না। এছাড়া এই মেশিন ব্যবহারের পর তার সফওয়ার কাস্টমাইজ করতে পারেন না কর্মকর্তারা। এজন্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বুয়েটের আইসিটি বিভাগে দারস্থ হতে হয়।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় বুয়েটের সহায়তা চেয়ে অনেকবার বৈঠকও করেছে কমিশন। কিন্তু সে সময় নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে অপারগতা প্রকাশ করে বুয়েট। ফলে সমস্যায় পড়তে হয় কমিশনকে। এবং সেসব যন্ত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছিলো সেগুলোর সমাধান এখনো করতে পারেনি ইসি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বাংলানিউজকে বলেছেন, ইভিএম নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত। এই মেশিন শুধু যন্ত্র হিসেবেই বুয়েটের কাজ থেকে কিনেছিলো আগের কমিশন। কিন্তু এর প্রপার্টি স্বত্ব কেনা হয়নি। যে কারণে বুয়েট আমাদের যন্ত্র চালানোর সফটওয়ার হন্তান্তর করেনি এখনো। বর্তমানে তারা প্রয়োজনীয় সহায়তাও দিচ্ছে না।
‘জাতীয় নির্বাচনে এটি আর ব্যবহারের আশা নেই’ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন লোকবল না থাকা এবং বড় দল বিএনপির আপত্তি থাকায় এটি সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করা যায়নি। সামনের নির্বাচনেও ব্যবহার করা যাবে না। তবে ছোট ছোট নির্বাচন যেমন ইউনিয়ন পরিষদে এটি ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনা চলছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেছেন, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে আপাতত আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে ছোট ছোট নির্বাচনে ইচ্ছা করলে এটা ব্যবহার করতে পারে কমিশন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘন্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৪