ঢাকা: তাসনুভা তাহমিনা মেডিকেল শিক্ষার্থী। অবসর আড্ডায় বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যান ক্যাফে মেট্রোতে।
তার ভাষায়, ‘ক্লান্ত হয়ে নিজেকে রিফ্রেস করি। সঙ্গে মুখে তুলে নেই কম ক্যালোরির চিকেন পাই ধরনের ফার্স্টফুড’।
কেবল তাসনুভা একাই নন। তার মতোই অনেকে ছুটে আসেন এই ক্যাফেতে। স্নিগ্ধ পরিবেশ, পরম আতিথেয়তা, ফ্রেস আর মজাদার খাবারের টানে দল বেধে সেখানে যাওয়াটাই যেন তরুণ প্রাণে ‘ট্রেন্ড’ ছড়িয়েছে সাভারে।
সবার মুখেই এখন ক্যাফে মেট্রোর নাম। রুচিশীল পরিবেশ, স্বাদে ভরপুর খাবার। বিশেষ করে তেল আর চর্বি ছাড়া ফাস্টফুডে এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন মাঝবয়সীরাও।
তেল ছাড়া, কোলস্টেরেলমুক্ত। সুস্বাদু খাবার তৈরিতে ডুবো তেলের পরিবর্তে ওভেনে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এখানে তৈরি হয় মজাদার চিকেন পাই, চিলি চিকেন রোল, সসেজ রোল, পিজা, ক্রুসান রোল, চিকেন, ভেজিটেবল পেটিস। রয়েছে তন্দুরি চিকেন, কাবাবের হরেক রকম আইটেমও। আরও আছে চিকেন টিক্কা, তাকদি কাবাব, শিক কাবাব ও শাসলিক।
এখানে পাওয়া যায় স্পেশাল লাচ্ছি, ফ্রেস হোম স্টাইল পিজা, ফ্যাট ফ্রি কেক, ডায়াবেটিস ব্রেডসহ নানা পদের বাহারি সুস্বাদু আর স্বাস্থ্যকর সব খাবার।
রয়েছে চায়নিজের নানা আইটেম। পার্টি, জন্মদিন ছাড়াও সভা-সেমিনারে খাবার সরবরাহ করতেও ব্যস্ত থাকে এই ক্যাফে।
সাভার থানা রোড বলে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম সন্দ্বীপ সড়কে মহিলা কলেজ ছাড়িয়েই এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পথে দেখা মিলবে ক্যাফে মেট্রো নামের এই ক্যাফের।
সেই খাবার-দাবারের প্রতিষ্ঠানের দিন দিন ছড়ানো সুনামের রহস্য জানতে গিয়েই বের হয়ে এলো আরেক খবর। পেশাদার মেরিন ইঞ্জিনিয়ার থেকে সুপার শেফ হওয়ার কাহিনী। আর সেই কাহিনীর রূপকারই হচ্ছেন ক্যাফে মেট্রোর উদ্যোক্তা আশরাফুজ্জামান (৫১)।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের মরহুম হযরত আলী সরকারের সন্তান আশরাফুজ্জামান ছিলেন পুরোদস্তুর মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।
এক ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে সবার বড় আশরাফুজ্জামান নারায়ণগঞ্জ মেরিন টেকনোলজি ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা শেষে লাইটার জাহাজে যোগ দেন শিক্ষানবিশ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।
অবশ্য তার আগেই ১৯৮৯ সালে যখন চতুর্থ সেমিষ্টারের শিক্ষার্থী, তখন বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। বিয়ে করেন চাঁদপুরের উত্তর মতলব থানার বাগানবাড়ি গ্রামে। আব্দুল সামাদ মোল্লার মেয়ে শাহিনা আক্তারকে।
১৯৯১ সালের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে প্রতিষ্ঠানের মাদার ভ্যাসেল ডুবে যায়। তবে নিজের জীবন রক্ষা পেলেও প্রকৃতির ভয়াল সেই তাণ্ডব প্রভাব ফেলে তার জীবনে। চলে যান সিঙ্গাপুরে। জাহাজ ছেড়ে কাজ নেন ক্যাপেল শিপ ইয়ার্ডে। পরে সেখান থেকে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন ইন্টিগ্রডেড টেকনিক নামের ভিন্ন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে।
শিপইয়ার্ডে চাকরির সুবাদে দেশে-বিদেশে ঘোরার সুযোগ পান আশরাফুজ্জামান। শখের বশেই ঘুরতে ঘুরতে ২০০১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি যান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।
সেখানে শিপইয়ার্ডে কোনো কাজ না পেয়ে ডেলিভারিম্যান হিসেবে ঘণ্টায় মাত্র ৪ ডলার বেতনে কাজ নেন গাই অ্যান্ড গেলার্ড নামের একটি চেইন ফাস্টফুডের দোকানে।
চার মাস পর কাউন্টার পার্সন হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। সেখানে বছরখানেক কাজ করে যোগ দেন এইচঅ্যান্ডএইচ ব্যাগেলস্ নামের ভিন্ন আরেকটি ফাস্টফুডের দোকানে। বেতন ঘণ্টায় ৭ ডলার। এখানেই ফিস স্যালমন ফিস, সেবল ফিস, স্টারজন ফিস স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি, টুনাফিস সালাদ, গ্রিক সালাদ, বিন সালাদ, ফ্রুট সালাদ ছাড়াও নানা আইটেমের খাবার তৈরিতে পারদর্শিতা অর্জন করেন আশরাফুজ্জামান।
ততোদিনে বেতন যেমন বেড়েছে, তেমনি পদোন্নতি পেয়ে সামাল দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন কো-ম্যানেজারের পদ।
বাবার মৃত্যুর খবরে আমেরিকার পাততাড়ি গুটিয়ে একমাত্র ছেলে হিসেবে ২০০৯ সালের ২৩ মে দেশে ফিরে আসেন আশরাফুজ্জামান।
সাভার তখন শিল্প আর আবাসিক ভবন নির্মাণে অগ্রসরমান। থানা রোডে খুলে বসেন থাইয়ের ব্যবসা। সেটার অফিস কক্ষে কেবলমাত্র নিজের গ্রাহকদের আপ্যায়নের জন্যে চালু করেন কফিশপ।
২০১০ সালের এপ্রিলে নতুন এ যাত্রা শুরু। আমেরিকার ফাস্টফুডের দোকানে কাজ করার নেশা তখনো কাটেনি। সংযোজন করলেন ফ্রুট জুস।
কিন্তু আমেরিকার স্বাদ আর দেশি স্বাদ তো ভিন্ন। এবার সংকল্প নেন দক্ষ শেফ হবার। ভর্তি হন টমি মিয়া’স হসপিটালিটি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটে।
নর্থ ইন্ডিয়ান ফুড, কন্টিনেন্টাল ফুড এবং হরেক রকম কাবাব তৈরির হাতেখড়ি নেন সেখানেই। এভাবেই এককালের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠেন সুপার শেফ।
ক্রমেই খ্যাতির সঙ্গে বিস্তৃত হতে থাকে আশরাফুজ্জামানের ব্যবসার পরিধি। জনপ্রিয়তা আর রুচিশীল খাবারের চাহিদা মেটাতে সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকায় করেন ক্যাফে মেট্রো টু নামের আরেকটি ক্যাফে।
দিন দিন ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় থানা রোডের ক্যাফে মেট্রোর হাল ধরেছেন স্ত্রী শাহিনা আক্তার। এ দম্পতির একমাত্র মেয়ে দিলরুবা জামান দিশারী এ-লেভেল ফাইনাল দিচ্ছেন।
শাহিনা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘উচ্চাকাঙ্খা তেমন কিছু নেই। মানুষের মুখে স্বাস্থ্যকর খাবার তুলে দিতে পারছি, হালাল রুজি করছি- এটাই জীবনের তৃপ্তি। এখন একমাত্র লক্ষ্য, মেয়েকে মানুষ করা’।
এ অগ্রযাত্রায় থেমে নেই আশরাফুজ্জামান। উদ্যমী এ মানুষটি বড় পরিসরে আরো একটি ক্যাফে নিয়ে আসছেন থানা রোডেই। হেলদি, ফ্রেস, হাইজেনিক ফুডের পাশাপাশি সেখানে থাকবে শতাধিক নতুন আইটেমের খাবার।
‘আমার পরের ইচ্ছে ফুডের ওপরই গ্রাজুয়েশন করা’- বললেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার থেকে সুপার শেফ হওয়া আশরাফুজ্জামান।
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৬
এমআই/এএসআর