ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ওষুধিগুণে চাহিদা বাড়ছে খুলনার চুইঝালের

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
ওষুধিগুণে চাহিদা বাড়ছে খুলনার চুইঝালের ফুলতলা বাজারে চুই বিক্রেতা আলমগীর সরদার। ছবি: আসিফ আজিজ

খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলে সব ধরনের মাংস রান্নায় চুইয়ের ব্যবহার বহু আগে থেকেই। এর খ্যাতি এখন রাজধানীসহ দেশজুড়ে। কিন্তু চুইঝালের পাতাও যে ফেলনা নয় তা আগে জানা ছিল না। খুলনার মানুষ চুইয়ের ঝাঁঝ-স্বাদে মজে এখন শাক-সবজি, তরকারি, মাছঝোলের সঙ্গেও খান দারুণ ওষুধিগুণের চুই।

খুলনা থেকে: খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলে সব ধরনের মাংস রান্নায় চুইয়ের ব্যবহার বহু আগে থেকেই। এর খ্যাতি এখন রাজধানীসহ দেশজুড়ে।

কিন্তু চুইঝালের পাতাও যে ফেলনা নয় তা আগে জানা ছিল না। খুলনার মানুষ চুইয়ের ঝাঁঝ-স্বাদে মজে এখন শাক-সবজি, তরকারি, মাছঝোলের সঙ্গেও খান দারুণ ওষুধিগুণের চুই।

অনেকটা পানপাতার মতো দেখতে পাতাগুলো শাকের সঙ্গে দিয়ে খাওয়া হয়। আর চিকন শাখা-প্রশাখা, পাতার ডাঁটা দেওয়া হয় সবজি, ভাজি ও তরকারিতে। মাছঝোলের স্বাদেও নাকি আভিজাত্য আনে চুইঝাল। চুই মোটা হলো ৬ থেকে আট ফালি, মাঝারি হলে চার ফালি, আর চিকন হলে দুই ফালি করে কেটে তরকারিতে দিতে হবে।

চিকন চুই।  সবজি-তরকারিতে খাওয়া হয় এ ধরনের চুই।
চিকন চুই সবজির সঙ্গে রান্না হয়। চুইয়ের গোড়ার শিকড়ও খাওয়া হয়। এটা বেশি খাওয়া হয় শীতকালীন সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি প্রভৃতির সঙ্গে। শিক্ষক তরুণ কান্তি সেন ৭০ টাকায় মাঝারি সাইজের খুলনার ১০০ গ্রাম চুই কিনলেন মাংস খাওয়ার জন্য। তিনি বলেন, আমরা এখন সবজির সঙ্গেও খাই। তবে শীতকালে বেশি খাওয়া হয়। কারণ এসময় সবজি বেশি মেলে।

খুলনা, বাগেরহাটের চুই রান্নার মধ্যবর্তী সময়ে দিলেই গলে যায়। কিন্তু পাহাড় কিংবা রংপুরের চুই রান্না শুরুর সময় দেওয়াই ভালো বলে জানান ব্যবসায়ী সাদ হোসেন। তিনি জানান, মাঝারি চুইয়ের চাহিদা সবসময় বেশি। দামে এ অঞ্চলের হলে ৪ থেকে ৭শ টাকা কেজি। পাহাড় হলে ১ থেকে ২শ। আর রংপুর ৩-৪শ। আর চিকনগুলো ১ থেকে দেড়শো টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। পাতা কিংবা একেবারে চিকনগুলোর কেজি ৬০-১০০ টাকার মধ্যে।

বিক্রির জন্য কাটা হচ্ছে চুই।
একটি চুই গাছের মাটির নিচের গোড়া, গোড়া, মাঝামাঝি জায়গা ও আগা আলাদা দামে বিক্রি হয়। একেবারে মাটির নিচের গোড়ার দাম সবচেয়ে বেশি। এর স্বাদও ভালো, আবার নরম।
 
ওষুধিগুণ
ফুলতলার চুই ব্যবসায়ী সৈয়দ সোহাগ, সাদ হোসেন, আলমগীর সরদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, চুইঝালের অনেক উপকারী ওষুধি গুণ রয়েছে। যে কারণে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সিজার রোগীদের জন্য এটা খুবই উপকারী। দ্রুত ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। টনসিল ও লিভারের জন্য চুইয়ের রস ভালো টনিক। এছাড়া সর্দি, কাশি ও মুখে রুচি আনার জন্য ঝাল ঝাঁঝের চুইঝাল বিশেষ উপকারী। কফ পরিষ্কার করতে ভূমিকা রাখে।

পাইকারের বাড়ির গোডাউনে চুই।
যারা একবার উপকার পেয়েছেন তারা এখন শুধু মাংসের সঙ্গে খাওয়ার অপেক্ষা না করে সব ধরনের সবজি-তরকারির সঙ্গে চুই খাচ্ছেন বলে মত এ ব্যবসায়ীদের।
 
পাইকারি বাজারের খোঁজ-খবর
ফুলতলা বাজারের সবচেয়ে বড় পাইকারি চুই ব্যবসায়ী মো. দেলোয়ার হোসেন। ব্যবসা করছেন ৬ বছর। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো প্রায় ২৫ মণ চুই তার গোডাউনে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখন সারাবছরই চুইয়ের চাহিদা থাকে। তবে ঈদের ১০-১৫ দিন আগে চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সিলেট, চট্টগ্রাম ও রংপুর থেকে আমি বেশি চুই নিয়ে আসি। মাঝারি চুই চলে বেশি। আর খুলনা অঞ্চলের চুই খুব কম পাওয়া যায়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খুব কম চাষ হওয়ায় পাওয়া যায় না।

পাইকারি ব্যবসায়ী মো. দেলোয়ার হোসেন তার গোডাউনে।
খুচরা বিক্রেতারা দিনে ৪-৫ হাজার টাকার চুই বিক্রি করেন। আর পাইকারি ব্যবসায়ী দেলোয়ার সেখানে বিক্রি করেন প্রতি মাসে এক থেকে দেড়শো মণ। খুলনা অঞ্চলেরটা ১৬-১৭ হাজার টাকা, রংপুরেরটা ১২-১৩ হাজার ও পাহাড়ি চুই বিক্রি হয় ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা মণ। পাহাড়ি চুই দেখতে ভালো, দামও কম। তবে ঘ্রাণ এদিকের মতো নয়।

ঈদের আগের এক সপ্তাহে তিনি ৩-৪শ মণ চুই বিক্রি করেন বলেও জানান।

ফুলতলা বাজারে সাজানো বিভিন্ন ধরনের চুই।
সংরক্ষণ করবেন যেভাবে
বহু পর্যটক খুলনা-বাগেরহাট এসে চুই কিনে নিয়ে যেতে চান বেশি করে। তবে সমস্যায় পড়েন সংরক্ষণ করতে গিয়ে। কাঁচা ডাঁটাজাতীয় এ গাছ শুকিয়ে কিংবা পচে যায় সহজেই। সংরক্ষণের কয়েকটি উপায় বলে দিলেন বিক্রেতারা।

প্রথমত, হালকা পানি ছিটিয়ে তাজা রাখা যায়। তবে দীর্ঘদিনের জন্য রাখতে হলে ছালা বা পাটের চট দিয়ে মুড়ে তাতে হালকা পানি ছিটিয়ে রাখতে হয়। পানি ছিটাতে হবে সপ্তাহে এক অথবা দুবার। মনে রাখতে হবে, বেশি পানি দিলে আবার পচে যাবে।

দ্বিতীয়ত, সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজও ভালো জায়গা। ফ্রিজে আলগা অবস্থায় রেখে তাতে হালকা পানি ছিটিয়ে দিলে কয়েক সপ্তাহ ভালো থাকে। মাঝে মাঝে খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি শুকিয়ে যাচ্ছে কিনা। সেটা লক্ষ্য রেখে পানি ছিটালে আর সংরক্ষণের চিন্তা থাকবে না।

কাঁচা চুই ডাল।
চুই বাগান
চাষিদের মতে, বেলে দোঁআশ মাটিতে ভালো হয় চুই। মাটিগুণেই খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলে ভালো চুই হয়। দেশের অন্য এলাকায় এখন কিছু চাষ হলেও তা এখানকার মতো হয় না। চুই গাছ বাঁচানো এক দুষ্কর কাজ। বেশি শীত, বেশি গরম আবার বেশি বর্ষা হলে গাছ মারা যায়।
 
এমনও হয়, ১০০টি গাছ লাগালে তার মধ্যে বাঁচে ৫টি। তবে গাছ লাগানোর বিশেষ টেকনিক রয়েছে। স্থানীয় ভাষায় ফড়কি বা গিরা থেকে গজানো নতুন ডাল কেটে দুই থেকে ৫ গিরা পর্যন্ত মাটিতে গর্ত না করে পাতিয়ে পুতে দিতে হয়। যেহেতু লতানো গাছ হয়, সেহেতু নরম যেকোনো গাছে তুলে দিলেই ভালো। এতে গাছ শক্তি পায় বেশি। আকারে বড় ও মোটা হয় দ্রুত।

আম, জাম, জিওল, সজনে, পেঁপে গাছে দ্রুত বাড়ে চুই। বছর দেড়েক হলে চুই গাছ কাটার উপযোগী হয়। তবে তিন-চার বছর রাখতে পারলে একটি গাছ ৩-৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।

** ষাটগম্বুজ মসজিদে কত গম্বুজ!
** চিনে খান খুলনার বিখ্যাত চুইঝাল
** ট্যাংরা-পারসের ছটফটানি বাগেরহাট বাজারে (ভিডিও)
** ‘উলুঘ খানের’ ঘোড়া দীঘি টানছে পর্যটক (ভিডিও)
** বাগেরহাটের মিনি কুয়েত!
** পরিযায়ী পাখি যাচ্ছে পর্যটক-ব্যবসায়ীর পেটে
** সুন্দরে এতো হিংসে কেন!

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
এএ/এইচএ/জিপি
সহযোগিতায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।