শহরে এসে নেমে দাঁড়িয়ে আছি ঐতিহ্যবাহী রেলজংশনের প্লাটফর্মে। লাল-রঙা বিশাল স্টেশন ভবন এবং প্লাটফর্ম যেন সাক্ষী দিচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই জংশনের আয়তনও অত্যন্ত বিশাল। রয়েছে বেশ কয়েকটি প্লাটফর্ম। হরদম যাওয়া আসা করছে ট্রেন। এছাড়া প্রচুর মালবাহী ওয়াগনকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো জংশনের ভেতর দিয়ে যাওয়া ব্রডগেজ রেললাইনগুলোতে।
গ্রীষ্মের কড়া দুপুর হলেও প্লাটফর্মের চারিদিকে খোলা থাকায় বাতাস বইছে ভালোই। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছি, এমন সময় স্টেশনের জিআরপি কন্ট্রোল রুমের সামনে চোখে পড়লো বোরকা পরা একজন ভদ্রমহিলাকে ঘিরে কয়েকজনের জটলা। একটু দূরে থাকায় হট্টগোলের কারণ ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। তবে বিষয়টি চোখও এড়ালো না।
যা হোক, বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে গেলাম পরের প্লাটফর্মে। হঠাৎ স্টেশনের লাউডস্পিকারে শোনা গেল খরখর আওয়াজ। না কোনো ট্রেনের আগমনী ঘোষণা নয়। বরং প্রচার হলো হারানো বিজ্ঞপ্তি। জাকারিয়া নামে ৮ বছরের একটি ছেলে প্লাটফর্ম থেকে হারিয়ে গেছে, যদি কোনো সহৃদয় ব্যক্তি.... ইত্যাদি।
ততক্ষণে আমি অবশ্য প্লাটফর্ম থেকে আরও দূরে। টপকাচ্ছি রেললাইন। এমন সময় প্লাটফর্মের অপর প্রান্ত থেকে একটি ৭-৮ বছরের ছেলেকে নিয়ে আসতে দেখা গেল একজন মানুষকে। দূর থেকে অস্বাভাবিক কিছু মনে না হলেও ছেলেটির হাত ধরে তার হন্তদন্ত হয়ে চলার ভঙ্গিটাই চোখে ধরলো আলাদা করে।
হঠাৎই যেন মাথায় ঢুকলো পুরো বিষয়টি। মহিলাকে ঘিরে রাখা জটলা। তারপর হারানো বিজ্ঞপ্তি। সবশেষে একটি ছেলেকে নিয়ে এক ব্যক্তির হন্তদন্ত হয়ে পথ চলা। দুই দুইয়ে যেন মিলে গেলো চার।
আমরা সাংবাদিকরা আসলে সবসময়ই অপেক্ষা করি নাটকীয় কোনো মুহূর্তের। সাংবাদিকতা জীবনের রোমাঞ্চই হলো নাটকীয় এই মুহূর্তগুলো। তাই সম্ভাব্য একটি নাটকীয় ক্ষণের উত্তেজনা আমাকেও গ্রাস করলো মুহূর্তে। আমিও ছুটলাম কন্ট্রোল রুমের দিকে। সাক্ষী হলাম মা ও তার হারিয়ে যাওয়া বুকের ধনের পুনর্মিলনের দৃশ্যের। হারিয়ে যাওয়া ছেলে জাকারিয়া ফিরেছে তার মায়ের কোলে। মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে নিলাম মধুর এই দৃশ্য। মা ও ছেলে দুইজনের চোখে তখন আনন্দ অশ্রু।
মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, একমাত্র ছেলে জাকারিয়াকে নিয়ে ট্রেনে করে ঈশ্বরদী আসছিলেন তিনি। ট্রেন থেকে নামার সময় তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় ছেলে জাকারিয়া। ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে না পেয়ে উদভ্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। যোগাযোগ করেন জিআরপি কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে।
কথা হয় শিশুটিকে খুঁজে পেয়ে মায়ের হাতে তুলে দেয়া সহৃদয় ব্যক্তিটির সঙ্গেও। জানালেন, ছেলেটিকে স্টেশনের শেষ মাথায় এদিক ওদিক ঘুরতে দেখে সন্দেহ হয় তারা। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায় মাকে খুঁজে না পাওয়ার কথা। পরে তাকে নিয়ে রওনা হন স্টেশনের কন্ট্রোলরুমের দিকে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৭
জেডএম/