ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘দিন যত যাচ্ছে, জিন তত উগ্র হচ্ছে!’

কাজল কায়েস, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১১
‘দিন যত যাচ্ছে, জিন তত উগ্র হচ্ছে!’

রায়পুর (লক্ষ্মীপুর): লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ২মাসে পর্যায়ক্রমে ২ শতাধিক শিক্ষার্থী অজ্ঞাত রোগে অসুস্থ হয়েছে। এরমধ্যে দু’জন ছাত্র, বাকীরা সবাই ছাত্রী।

আর গণহারে শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হওয়াকে পুঁজি করে ঝাড়-ফুঁকের নামে এলাকার কিছু মতলববাজ টু-পাইস কামানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরমোহনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘জিনের আসর’ থেকে স্কুলকে মুক্ত করতে ৩৮ জন ইমাম দিয়ে শেফা খতম পাঠ, মিলাদ ও দোয়া, ৪২ কেজি মিষ্টি বিতরণ, ১৫০টি ‘তদবীর দেওয়া’ তাবিজ আগুনে পোড়ানো, ৭জন ইমাম দিয়ে সূরা-জিন ১০১ বার দেখে দেখে পাঠ, সুতা দিয়ে তাবিজ ঝোলানো, কথিত জিনের বাদশাকে ‘সতর্কতামূলক চিঠি পাঠানো’, বাঁশের খুঁটিতে লাল পতাকা ওড়ানো ও ঝাড়ফুঁকসহ জানা-অজানা তদবির বলতে কোনওকিছুই বাকি রাখেননি। সাধ্যমতো সবকিছুই করা হয়েছে। কিন্তু কাঙ্খিত ফল আসেনি। অবস্থা এমন হয়েছে যে সাধারণ মানুষের মনে এখন এ ধারণা স্থির হতে যাচ্ছে যে ‘দিন যত যাচ্ছে, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরমোহনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসর গাড়া জিন বা জিনেরা তত উগ্র হচ্ছে!’

বিদ্যালয় অঙ্গনের কথিত ‘জিন-পরী’ তাড়াতে শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও অভিভাবকরা চাঁদা তুলে কয়েকজন ইমাম ও কবিরাজের পরামর্শে ওপরে উল্লেখিত যাবতীয় আনুষ্ঠানিতার আয়োজন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।

ঘটনার শুরু থেকে অসুস্থ ছাত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা অজানা আতংকে রয়েছেন। অসুস্থদের কেউ কেউ রাতে ঘুমের ঘোরে চিৎকার ও কান্নাকাটি করে ওঠে। তারা বলছে- ‘কে যেন তাদের ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে’। এজন্য আক্রান্ত অনেকের পরিবারের এখন  রাত কাটে নির্ঘুম।

রায়পুর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের ৩নং চরমোহনা ইউনিয়নে অবস্থিত ওই স্কুলে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩৮০ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যায়নরত। ৫ জন শিক্ষক নিয়মিত পাঠদান করে আসছেন। টিনসেড ওই বিদ্যালয়ের পরিবেশ তেমন একটা ভালো নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছেন, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে মিলাদসহ নানা আয়োজনের জন্য ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এলাকাবাসী, ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষক ও ছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকা থেকে কিছু অংশ নিয়ে এ ব্যয় করা হয়। জিন তাড়ানোর জন্য হায়দরগঞ্জের এক তদবিরকারী হুজুর ৩০ হাজার ও শহরের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধর্ম শিক্ষক ৭ হাজার টাকা দাবি করেছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে তাদের কাছ থেকে সেই বিশেষ তদবির এখন আর নেওয়া যাচ্ছেনা।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘ক্লাশ চলাকালীন সময়ে ছাত্রীরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাটিতে লুটে পড়ে। তারা উচ্চস্বরে অসংলগ্ন কথা-বার্তা ও অশোভনীয় অঙ্গভঙ্গি করে। অসুস্থরা ১ থেকে ৭ ঘণ্টা পর সুস্থ হতে শুরু করে। দুপুরে যোহরের নামাজের সময় ছাত্রীরা অসুস্থ হয়। সুস্থ হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ জিন-পরী কর্তৃক তাদেরকে মারধর ও ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কথা আমাদেরকে জানায়। ’

তদবিরকারী হুজুরদের কথা
বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ‘জিন-পরী’ অবস্থান করছে। ছাত্রীরা বিদ্যালয় আসলে তাদের ওপর এরা ভর করে। এতে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়। জিনের ওই আস্তানায় অনেক সদস্য আছে। কিছুতেই তাদেরকে দমানো যাচ্ছেনা। সব ধরনের তদবির দেওয়া শেষ। এখন কারোর কিছুই করার নেই।

রায়পুর উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের খতিব ও ওই বিদ্যালয়ে জিন তাড়ানোর তদবিরকারী মাওলানা আবুল হোসাইন বলেন, ‘জিন-পরী তাড়াতে আমি বিদ্যালয়ে ৫-৬ বার গিয়েছি। সেখানে জিনের আস্তানা আছে। বর্তমানে দিন যত যাচ্ছে, জিন তত উগ্র হচ্ছে। আমার পরামর্শক্রমেই শিক্ষক ও এলাকাবাসী শেফা খতম, বিদ্যালয়ে মিলাদ ও তাবিজ পুঁড়িয়েছে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘নিরুপায় হয়ে শেষমেশ সূরা জিন পাঠ ও জিনের বাদশাকে সতর্ক করে চিঠি ও লাল পতাকা ঝুলিয়েছি। আমি আমার অবস্থানে থেকে জিন তাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হচ্ছেনা। আসলে বিষয়টি রহস্যজনক। তবে জিন তাড়ানোর নামে কেউ আর্থিক চুক্তি করলে তা সম্পূর্ণ হারাম। ’
 
হায়দরগঞ্জ তাহেরিয়া এমআর ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুল আজিজ মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ‘জিনের অস্তিত্ব আছে সত্য। জিন দুই-একজন ছাত্র-ছাত্রীর ওপর ভর করলে তারা অসুস্থ হতে পারে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বেশি সংখ্যক ছাত্রী অসুস্থ হওয়ার কথা নয়। ’

এ সুযোগে কিছু লোক জিনের ধোঁয়া তুলে ব্যবসা করছে বলে তিনি দাবি করেন।

তদবিরকারী রায়পুর উপজেলা ইমাম ও মুয়াজ্জিন সমিতির সভাপতি সালেহ আহাম্মদ বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক আমাকে বিদ্যালয়ে নিয়ে গেছে। আমি অসুস্থদের সাথে কথা বললে তারা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে বিদ্যালয়ে জিন আছে, ভূত নেই। এর থেকে উত্তরণের জন্য আমি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লক্ষ্মীপুরের মান্দারীর জিন তাড়ানোর ওস্তাদ আবদুল সাত্তার খনকারের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছি। তিনি মারা গেছেন, তার ছেলে ফজল খনকার বর্তমানে এসবের ভালো তদবির দেন। ’

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব মাওলানা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের আল-জাবেরী আল-মাদানী মেলফোনে বাংলানিউজকে বলেন, ‘জিন আল্লাহ্র সৃষ্টি। তাদের মধ্যে ভালো-খারাপ দু’টিই আছে। তবে রায়পুরের ওই বিদ্যালয়ের বিষয়টি আমি অবগত নই। বিস্তারিত জানলে ব্যাখ্যা করা যাবে। ’

স্বাস্থ্য বিভাগের কথা
চরমোহনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রহস্যময় এ সমস্যা মোকাবেলায় তথা অসুস্থ খিশক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া ও এর কারণ খুঁজে বের করতে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা বিদ্যালয় ও অসুস্থ ছাত্রীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। ভয়ভীতিজনিত কারণে ছাত্রীরা একে অপরের ভীতিতে সংক্রমিত ও অসুস্থ হয়ে পড়ে বলে তারা জানান। তারা বলেন, তাদেরকে মানসিকভাবে বল দিতে হবে।

মেডিকেল টিমের প্রধান ডা. ইফতেখার-উল-হক খান জানান, তদন্ত টিম একটি প্রতিবেদন দায়ের করেছে। সেখানে ঢাকা থেকে মানসিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ-ডাক্তারদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী টিম গঠন করে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

তিনি আরও জানান, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণহারে অসুস্থ হওয়ার এ বিষয়টি গণ-ভয়ভীতি জনিত অসুস্থতার (Mass Psychogenic Illness) কারণে হয়ে থাকতে পারে।

বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্টজনের কথা
এ ব্যাপারে সাধারণ্যে ধারণা যাই হোক- এলাকার শিক্ষিত ও সচেতন মহলের মতে, জিন-পরী নিয়ে মাতামাতি সম্পূর্ণ কুসংস্কার। কিছু লোক ব্যাপকহারে এসবের ধোয়া তুলে ব্যবসা করছে। জীবন প্রণালী পরিবর্তন, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা, মনোবল বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাই পারে এসব ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে।

জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মাইন উদ্দিন পাঠান মুঠোফোনে বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে ছাত্র-ছাত্রী অসুস্থ হওয়ার ঘটনাটি মানসিক রোগ হতে পারে। জিন-ভূতের কথা সম্পূর্ণ কুসংস্কার। গ্রামের সহজ-সরল লোকের মাঝে থাকা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে পুঁজি করে কিছু মতলববাজ ব্যক্তি এক ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় ও সুস্থ বিনোদনের চর্চাসহ জীবন প্রণালী পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব মোকাবেলা করতে হবে। ’

রায়পুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক জহির উদ্দিন ভূঁইয়া (ইত্তেফাক) এ ঘটনার জন্য উপজেলা ও স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘এর থেকে উত্তরণের জন্য বিদ্যালয়ে দ্রুত স্বাস্থ্য বিভাগের মনিটরিং প্রয়োজন। শিক্ষকরা নিজেরাই জিন-ভূতের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর মাঝে আতংক সৃষ্টি করছে। ’
 
ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা নাজমুল আলম মিঠু বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনা নিয়ে এলাকাবাসী আতংকিত। ডাক্তার, কবিরাজ ও হুজুররাও নানা তদবির করে বিষয়টির কোনও সুরাহা দিতে পারেননি। ঘটনাটি রহস্যজনক। ’

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ইউনিয়ন আ’লীগ সভাপতি মোস্তফা কামাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘জিন-পরী তাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ৭০-৮০ হাজার টাকা শেষ হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বছর খানেক আগে আমাদের পার্শ্ববর্তী আবদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে একই ধনের ঘটনা ঘটে। সেসময় ১০-১৫ দিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়ের ঘটনা ব্যতিক্রম। ৬ মাস যাবত আমরা ভীত সন্ত্রস্ত দিন কাটাচ্ছি। আক্রান্ত ছাত্র-ছাত্রীরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ’

তবে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি নিজে জিন-পরী বিশ্বাস করেন না বলে দাবি করেন।

যেখান থেকে ঘটনার শুরু
গত ২৪ মার্চ সকালে শ্রেণি কার্যক্রম চলার সময় হঠাৎ চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তার প্রচ- মাথাব্যাথাসহ চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। কয়েকজন শিক্ষক তাকে বিদ্যালয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরে রিক্সাযোগে বাড়িতে পৌঁছে দেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিদ্যালয়ে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ৫-৭ জন ছাত্রী অজ্ঞাত রোগে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে। এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে গত ৯ এপ্রিল বিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরদিন বিদ্যালয়ে এসে পুনরায় ১০-১৫ ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে।

বিষয়টি তাৎক্ষণিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশিদ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে অবগত করেন। শিক্ষা অফিস থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সরেজমিন বিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এর আলোকে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য ১২ এপ্রিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. ইফতেখার উল হক খান ও ডা. মোরশেদ আলমের সমন্বয়ে একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়।

ওই টিমকে গত ১৮ এপ্রিল সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এছাড়া উপজেলা পরিষদের মাসিক আইন-শৃংখলা কমিটির সভায়ও ছাত্রীদের অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি আলোচিত হয়।

বারবার অসুস্থ হচ্ছে যারা
স্কুলে অসুস্থ হওয়াদের তালিকায় কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা একাধিকবার অসুস্থ হয়েছে। এরা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণির ফারজানা, তৃতীয় শ্রেণির পান্না আক্তার, খাদিজা আক্তার, সুইটি আক্তার, সুমি আক্তার, ফারজানা আক্তার, বিলকিছ, পপি, মরিয়ম, চতুর্থ শ্রেণির মিতু আক্তার, ফাতেমা আক্তার, নাজমুছ সাকিব, পান্না আক্তার, সাজু আক্তার, আমেনা বেগম, শাহনাজ আক্তার, সোনিয়া আক্তার, সুমি আক্তার, ফাতেমা আক্তার, ফাতেমা, মিতু আক্তার, মিম আক্তার, নাছরিন আক্তার, নাছিমা আক্তার, বিলকিছ আক্তার, জেসমিন আক্তার, শিমু আক্তার, খাদিজা আক্তার, পঞ্চম শ্রেণির শাহিনুর আক্তার, রনি হোসেন, সাজু আক্তার, শান্তা আক্তার, সাথী আক্তার, রাজিম হোসেন, সালম আক্তার রানী, পপি আক্তার, পপি, সালমা আক্তার, শিমু আক্তার, আসমা আক্তার, ইয়াছিন আক্তার, মরিয়ম আক্তার, লিমা আক্তার, মুক্তা আক্তার, হাছিনা আক্তার, জোৎন্সা আক্তার, সামিরা আক্তার, জোৎন্সা আক্তার ও মর্জিনা আক্তার।

রোগের লক্ষণ
শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসলে পর্যায়ক্রমে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। হঠাৎ করে তাদের প্রচ- মাথা ব্যাথা, জ্বর ও বমি হয়। আক্রান্তরা এরপর বেঞ্চ ও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি যায়। পরে জ্ঞান ফিরলে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। অসুস্থদের কারো কারো মুখ দিয়ে লালা ঝরে।
জবা, জোনাকী, দিদি মনি, সূর্যমুখী, নূপুর, ঝুমুর, রাজরাণী, কালাপরী, হলুদপরী, রাধাকৃষ্ণ, কৃষ্ণদাস, কৃতদাস, মানিক, লালপরী ও সাদাপরী নাম নিয়ে ছাত্রীরা নিজেদেরকে ‘জিন-পরী’ পরিচয় দিয়ে এ ধরণের আচরন করে।

অসুস্থ ছাত্রী লিমা আক্তার তার পিতাকে বলে- ‘তুই এখানে কি করছ?’ অন্যন্যারাও শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করে রুম থেকে তাদেরকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলে।

একবার সুস্থ হওয়ার পর বিদ্যালয়ে ফেরা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ পরে আরও ১০-১২ বার এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বাড়িতে থাকাকালীন তারা স্বাভাবিক থাকে। তবে রাতে কয়েকজন ছাত্র -ছাত্রী ঘুমের ঘোরে চিৎকার ও চেঁচামেচি করে ওঠে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন।

পরিদর্শকদের উপস্থিতিতেও অসুস্থ হচ্ছে
ঘটনাটি সম্পর্কে সরেজমিন জানতে স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিকেল টিমের পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. সালাউদ্দিন শরীফ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দুলাল চন্দ্র সূত্রধর, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এম খায়ের আহাম্মদ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. এমদাদুল হক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বেলায়েত হোসেন বিদ্যালয়ে একাধিক বার গেছেন। এসময় অসুস্থ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।

গত শনিবার দুপুরে (১৭ সেপ্টেম্বর) লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করতে যান। এসময় মেডিকেল টিমের সদস্যরা তার সঙ্গে ছিলেন। তাদের সামনেই ১৪ জন ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন সিভিল সার্জন উপস্থিত শিক্ষকদের কাছে বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) এ স্কুলে আবারো ২৪ ছাত্রী অসুস্থ হয়েছে। এদিন সকালে মেডিকেল টিমের প্রধান রায়পুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ইফতেরখার উল হক খান বিদ্যালয়ে আসেন। এসময় তার সামনেই ওই ছাত্রীরা পর্যায়ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি পরীক্ষামূলক ৪ ছাত্রীকে চিকিৎসা দেন। একপর্যায়ে তিনি দুপুর ১টার দিকে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন।

ডা. ইফতেখার উল হক খান অবস্থার উন্নতি না হওয়ার কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটি মানষিক রোগ হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক-অভিভাবকরা বড় ধরনের কষ্টে আছেন। আমি পরীক্ষামূলক ৪ ছাত্রীকে রিবোট্রিল (জরনড়ঃৎরষ) খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছি। তারা অন্তত দুই-তিন সপ্তাহ নিয়মিত ঔষধটি সেবন করলে প্রতিকার মিলতে পারে। ’

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য
এদিকে, লক্ষ্মীপুর সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. সালাউদ্দিন শরীফ মোবাইল ফোনে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছি। এটি একটি মাস সাইকোজেনিক (গণ ভয়ভীতি জনিত) রোগ। বিষয়টি নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি। ছাত্রীদের সুস্থ করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। ’

বিষয়টি নিয়ে তিনি উৎকন্ঠায় আছেন বলে জানান।

রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দুলাল চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘আমি ওই বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছি। বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তিত। বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের মনিটরিং ও আক্রান্ত শিশুদের ঢাকায় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। ’

জেলা প্রশাসক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দিয়ে বিষয়টি অবগত করবেন। এছাড়া সিভিল সার্জনের সাথে জরুরি ভিত্তিতে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

রায়পুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বেলায়েত হোসেন নিজেদের উদাসীনতার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘দফায় দফায় শুধুমাত্র এ বিদ্যালয়ে ছাত্রী অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। এনিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবগত করা হয়েছে। ঢাকা থেকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম এনে দ্রুত এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। ’

অভিভাবকদের কথা
পঞ্চম শ্রেণির বারবার অসুস্থ হওয়া ছাত্র রাজিম হোসেনের মা সুফিয়া আক্তার বলেন, ‘স্কুল গেছে আর একদিন অ্যার (আমাদের) হোলারে (ছেলে) জিনে হাইছে। হের বাপে বিদেশ থাহে (থাকে)। অ্যার মাইয়্যার ওরপেও (ওপরে) জিনে আছড় কইছ্যে। রাইত অইলে হোলার ছিল্লাছিল্লিতে (চিৎকার) ঘুমাইতাম হারিনা। হেরে জিনে জ্বাতি (চেপে) ধরে আর বাইরে নিতো টানাটানি করে। এগিন লই (সে জন্যে) হেইগ্যার বাপেও বিদেশে টেনশনে আছে। ’

সুফিয়া আক্তারের মতো আক্রান্ত প্রায় প্রত্যেক আক্রান্ত শিক্ষার্থীর বাড়িতে অভিভাবকরা একই অবস্থায় রয়েছেন।

আরেক অভিভাবক ও দক্ষিণ চরমোহনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ হাই বলেন, ‘আমি জিন-ভূত নিয়ে কোনও খনকারে বিশ্বাস করিনা। তবে বিদ্যালয়ের ঘটনাটিও বুঝতে পারছিনা। এটি রহস্যজনক। ’

বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে কথা হয় দক্ষিণ রায়পুর আবদুর রহমান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মহিন হোসেনের সঙ্গে। সে বলে, ‘ভূতের ডরে (ভয়) অ্যাঙ্গো (আমগো) বাইর (বাড়ির) পপি, আসমা, জান্নাত, ইসকুলে যায়না। হেগুনে (তারা) কইছে জিনে ইসকুলে গরু চাইছে। হরে (পরে) দেড় মন মিষ্টিদি মিলাদ হড়াইছে আরো হেতারা (জিন) মানেনা। ’

প্রসঙ্গত, এনিয়ে বাংলানিউজ-এ ১৪ সেপ্টেম্বর ‘অজ্ঞাত রোগ: রায়পুরে ফের অসুস্থ ১০ ছাত্রী, ২ মাসে আক্রান্ত ১৮০’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। এর আগেও ১৪ জুলাই ‘রায়পুরে অজ্ঞাত রোগে ৪৫ ছাত্রী অসুস্থ, মেডিক্যাল টিম গঠন’ ও ১৬ জুলাই ‘রায়পুরে ফের অজ্ঞাত রোগে ৭ ছাত্রী অসুস্থ’ শিরোনামে ছবিসহ তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশ হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৯ ঘণ্টা, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।