বিলে সদ্য লাগানো আমন ক্ষেতের সোনালি স্বপ্ন দুরন্ত বেগে ধেয়ে আসা পানির তোড়ের কাছে কতো অসহায়!
তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটির উত্তর পাশে উত্তরুল্লা (নীলকুঠি) গ্রাম প্লাবিত হয়েছে দু’দিন আগেই। সুরক্ষিত ছিলো পশ্চিম পাশের গ্রাম সানকিভাঙা।
পানির কাছে অসহায় মানুষগুলোর ছোটাছুটি, ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস বের করার আপ্রাণ চেষ্টার মধ্যে দেখা, বাঁধের যে অংশে ভেঙেছে সেই অংশ পরিদর্শন করে আসা বাঁধ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট একজনের। তার সঙ্গে বলতে বলতেই ‘আমার সব গেলো, আমার সব ভেসে গেলো’ আহাজারি শোনা গেলো। বয়স্ক এক ব্যক্তি রাস্তার পাশে নদীর দিকের পানিতে পড়ি মরি করে পড়লেন ঝাঁপিয়ে।
‘একটিও নেই, একটাও খুঁজে পাচ্ছি না, সব পানিতে ভেসে গেলো। একটা আছে, এই একটা শুধু আছে। এখানে সব খোঁটা পোতা ছিলো। আমার ৩০ হাজার টাকার পাট সব গেলো’।
কান্না কোনোভাবে বাঁধ মানলো না আর। ফেটে পড়লেন ‘বাঁধভাঙা’ কান্নায়।
হাতে ছোট একটি আঁটি উঠিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলেন ওমর ফারুক। না পচায় আগে তুলতে পারেননি। যেগুলো কাটা হয়নি, সেগুলোও গেছে ভেসে। তাই কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। পাট বিক্রি করে ক’টা দিন সচ্ছলভাবে চলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। কয়েক মাসের কষ্টের ফল ভোগ করতে পারলেন না গোটা তিনেক দিনের জন্য। এ কষ্ট কীভাবে লুকোবেন তিনি!
পানি থেকে রুদ্ধশ্বাসে ওপরে উঠে কাঁদতে কাঁদতেই খানিকটা দূরে দেখিয়ে বললেন, ‘আমি এখন কি করবো, কোথায় যাবো? আমার পাট ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, পুকুরটা এখন চেনাই যাচ্ছে না। ৫০ হাজার টাকার মাছ ছিলো। সব চলে গেলো বাবা, সব ভেসে গেলো’।
বাড়ির ভেতরেও পানি ঢুকেছে জানিয়ে বলেন, ‘বাড়িতে নাতি দু’টোরে টিনের চালের ওপর বসিয়ে রেখে এসেছি। বাড়ি, পুকুর, মাছ, পাট আমার সব শেষ। ঘরের জিনিসও সরাতে পারিনি। আমি এখন কোথায় যাবো?’
বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, বাঁধভাঙা আনন্দের কথা শুনেছি। যে আনন্দ, যে উচ্ছ্বাস কোনো বাধা মানে না। এবার মুখোমুখি সত্যিকারের বাঁধভাঙার। তবে এটা আনন্দ নয়, ‘বাঁধভাঙা’ কান্নার। যমুনার বাঁধ ভেঙে যে ক্ষতির মুখে পড়লেন ওমর ফারুকের মতো সানকিভাঙা গ্রামের মানুষ, তা সামনে দাঁড়িয়ে দেখা সত্যি অসহনীয়। মুহূর্তের আবেগ ভিজিয়ে দেয় চোখ।
এমন বাঁধভাঙা কান্না এখন সানকিভাঙা গ্রামের পথে-প্রান্তরে।
বাঁধ নির্মাণে জড়িত দাবি করে নাম-পরিচয় না জানানো ওই ব্যক্তি জানান, ৮৮ সাল ছাড়া কোনো সময় এটা ভাঙেনি। ‘ক্ষুদ্রাকার পানিসম্পদ’ প্রকল্পের আওতায় এ বাঁধের কাজ চলছে। ৬৪ লাখ টাকার কাজ। শুরু হয়েছে দুই বছর আগে। মোট দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটার। ভাঙার ব্রিজ থেকে ফুলছড়ি ব্রিজ পর্যন্ত। কিন্তু মাটির সমস্যায় কাজের ফিনিশিং টানা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও জানান, বাঁধের অবস্থা একটু খারাপ দেখে এলাকাবাসী দু’দিন ধরে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু কিছুতেই রক্ষা করা গেলো না। ভেসে গেলো গ্রামের পর গ্রামের সব ফসল, বাড়ি-ঘর।
চোখের সামনে ফসলের ক্ষেত, গাছ, পুকুরের মাছ, বাড়ি-ঘর, পশু-পাখির প্রকৃতির কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণ দেখা সত্যি কষ্টের! বাস্তুহারা পরিবারগুলোকে গুছিয়ে উঠতে আবার কতো সময় লাগবে কে জানে! প্রয়োজন পাশে দাঁড়ানো, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা।
** চটকা জালের মাছ-আলুভাজিতেই দানাপানি
** এ কেমন জীবন!
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
এএ/এএসআর