তাতে চরম দায়সারা ভূমিকাই পালন করলো সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো। চীন, রাশিয়া ও জাপান দায়সারা ভূমিকার পাশাপাশি প্রকারান্তরে মিয়ানমারের পক্ষেই পরোক্ষ অবস্থান নিল।
আলোচনার শুরুতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতিয়েরেস মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান ও নিধনযজ্ঞ বন্ধ করার আহবান জানান। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় মধ্যরাত একটার দিকে শুরু হয় নিরাপত্তা পরিষদের এই উন্মুক্ত আলোচনা।
সুনির্দিষ্ট শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা বা নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব না করে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো কেবল সহিংসতা বন্ধের আহবানই জানিয়ে নিজেদের দায়সারা ভূমিকা পালন করে গেল সুবচন আর নানা কথার ফুলঝুরিতে!
তারা নামকাওয়াস্তে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা জাতিংঘ মহাসচিবের আহবানে সুর মিলিয়ে দেশটিতে অবিলম্বে সেনাবাহিনীর সহিংস অভিযান বন্ধের আহবান জানিয়েছে, কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া চালু করার আহবান জানিয়েছে।
এর আগে নিরাপত্তা পরিষদের ৭টি সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সেনেগাল, মিশর, সুইডেন, ফ্রান্স ও কাজাখস্তান জাতিসংঘ মহাসচিবকে মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতির উপর নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতি প্রদানের অনুরোধ জানায়। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতির পর নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্যরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধিগণ বক্তব্য রাখেন।
মিয়ানমারে সংঘটিত মানবিক বিপর্যয় ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে এই সভায় বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
বাংলাদেশ ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর বাইরে এসভায় বক্তব্য রাখেন মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও স্টেট কাউন্সেলরের বিশেষ দূত ইউ থাঙ্গ্ তুন ( U Thaung Tun)|
নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব নেই কোনো
রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধের জন্য বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আশা করেছিল। কিন্তু তা হয়নি। এমন মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও অব্যাহত নিধনযজ্ঞ চলমান থাকা সত্ত্বেও কোনো সদস্য রাষ্ট্রই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করেনি। প্রস্তাব করেনি কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞারও। নিরাপত্তা পরিষদের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে কোনো ধরনের অস্ত্র সরবরাহ না করতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছে।
কোনো দেশের তরফে মিয়ানমারের ওপর নিষেজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব না করাটা ছিল এক কথায় বিস্ময়কর।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতিয়েরেস নিরাপত্তা পরিষদের আনুষ্ঠানিক উন্মুক্ত আলোচনার শুরুতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং লাখো লাখো শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। তিনি এই চরম মানবিক সংকটে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলেও অঙ্গীকার করেন। তিনি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, রাখাইনে সেনা অভিযান বন্ধ , মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের রাখাইনে প্রবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের পর এই প্রথমবারের মতো পূর্বনির্ধারিত আলোচ্যসূচিতে এসেছে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। গত ১৩ সেপ্টেম্বরের পর নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে এটি তৃতীয়বারের মতো আলোচনা।
কেবল নিন্দাতেই সীমাবদ্ধ বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো সহিংসতার তীব্র নিন্দা এবং অবিলম্বে তা বন্ধের আহ্বান জানালেও কোনোরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করেননি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ওপর চলমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে তিনি দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখতে সংশ্লিষ্ট সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান। তবে তিনি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পেছপা হবে না।
মিয়ানমারে বর্বরতা এবং জাতিগত সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞ চালানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি অং সান সুচির প্রতি পরোক্ষ ইঙ্গিত করে বলেন, সেখানে যা ঘটছে তাতে দেশটির নেতাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। এছাড়া রাখাইনে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকদের সহাবস্থান নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে দেশটিতে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব।
মিয়ানমারের পক্ষেই নির্লজ্জ অবস্থান নিল চীন
নিরাপত্তা পরিষদের আরেক স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র চীনের দেওয়া বক্তব্য ছিল সংক্ষিপ্ত, পক্ষপাতদুষ্ট ও দায়সারা। চীন রোহিঙ্গা সংকটকে জটিল আখ্যা দিয়ে এর দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর সমাধান আশা করে। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনের কোনোরূপ নিন্দা করেনি চীন। কে আক্রান্ত আর কে আক্রমণকারী –তা বেমালুম চেপে গিয়ে চীন শুধু বলেছে, তারা রাখাইনে সব ধরনের সহিংসতায় উদ্বিগ্ন।
এখানেই শেষ নয়, চীন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছে, ‘চীন মিয়ানমার সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানাচ্ছে। ’ এজন্য তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে আর একই সঙ্গে ধাপে ধাপে বিষয়টির সমাধান আশা করেছে।
চরম সুবিধাবাদী অবস্থান রাশিয়ার
রাশিয়ার অবস্থানও প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করারই নামান্তর। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থান চরম সুবিধাবাদেরই নির্লজ্জ পরাকাষ্ঠা। ‘আমরা দেখছি সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে’---এমনই পক্ষপাতদুষ্ট, বিবেকহীন অবস্থান ছিল রাশিয়ার।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসী কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা আর আরসার বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব দেয়ার মধ্য দিয়ে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢেকেছে’ ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমরা রাখাইন পরিস্থিতির অবনতির ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছি। আমরা দেখছি সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
রাশিয়াও আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়। তবে রাশিয়া মনে করে, সমাধানের উপায় বেশ জটিল।
চীন-রাশিয়ার পথেই হাঁটল জাপান
নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য জাপানের অবস্থানও ছিল ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি। ’ মিয়ানমারের নিন্দা না করে তারা কেবল রাখাইনে সহিংসতা ও কথিত আরাকান সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা)হামলার জোরালো নিন্দা জানিয়েছে। ‘এই মানবিক বিপর্যয়ে জাপান গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা মানবিক সহায়তার ওপর জোর দিচ্ছি। জাপান মনে করে, এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো কাজ এগিয়ে নেওয়া, বিশেষ করে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন ও মানবিক সহায়তা প্রদান। ’---এহেন দায়সারা আর পক্ষপাতদুষ্ট ছিল জাপানের অবস্থান।
ফ্রান্সসহ অন্যরাও নিন্দাতেই সীমাবব্ধ রাখলো ভূমিকা
নিরাপত্তা পরিষদের আরেক স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স বলেছে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব রয়েছে। সেখানে প্রথম অগ্রাধিকার হলো সহিংসতা বন্ধ করা এবং মানবিক সহায়তা দেওয়া। একই সঙ্গে মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার ও গণতন্ত্রের রূপান্তরে সমর্থন জানিয়েছে ফ্রান্স। চলমান সহিংসতার ব্যাপারে ফ্রান্স কেবল এটুকু বলেছে:‘...তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনে নীরব থাকা সম্ভব নয়। ’ ফ্রান্সের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকে অবাধে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রশংসা করে ফ্রান্স বলেছে, শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে। ফ্রান্স মনে করে, তাদের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হলো সেখানে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বৈষম্যের অবসান ও কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন।
এ যেনবা পর্বতের মূষিক প্রসব
সবকিছু মিলিয়ে এক বিশ্ববাসী আলোচনার নামে এক প্রহসনই মঞ্চস্থ হতে দেখলো নিরাপত্তা পরিষদে। যেখানে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো শাস্তির প্রস্তাব। চরম দায়সারা ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়েই শেষ হলো এই প্রহসনের আলোচনা---যা শূন্যগর্ভ আর অসার ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৭
জেএম