স্বজনদের কারো প্রতীক্ষা স্বামীর জন্য, কারো বাবা, কারো বা ভাই আর সন্তানের জন্য। একদিন জীবিত ফিরে আসবেন- এ অপেক্ষা দীর্ঘ ১০ বছরেও শেষ হয়নি, আজো ফেরেননি তারা।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরে নিখোঁজ ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চন্দ্র প্রসাদ গ্রামের ওই ৯ জেলে হলেন- বজলু মাল, রুবেল, জসিম, নুরু, সহিদুল, ইব্রাহিম, মামুন, জামাল ও রুবেল। এক দশক পার হলেও সন্ধান মেলেনি হতভাগ্য মানুষগুলোর। তারা বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন, তাও জানেন না কেউ।
তবে প্রতীক্ষায় থাকা তাদের পরিবারের সদস্যরা আজও প্রিয়জনের কথা মনে করে কেঁদে ওঠেন। এ কান্নারও কোনো শেষ নেই।
উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা নিখোঁজ থাকায় এসব পরিবারে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। অভাব-অনটনে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের।
সরেজমিনে চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, সিডরের কয়েকদিন আগে জসিম মাঝির ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ শিকারে গিয়েছিলেন জেলেরা। ফিরে এসে কারো নতুন ঘর তৈরি, কারো বিয়ে বা সন্তানের বই-খাতা কিনে স্কুলে ভর্তি করানোর কথা ছিলো। কিন্তু সিডরের ঝড়ে ট্রলারডুবির পর ফিরে না আসায় সে কাজগুলো অসমাপ্তই রয়ে গেছে।
নিখোঁজ বজলু মালের স্ত্রী মনোয়ারা বাংলানিউজকে বলেন, ‘৫ মেয়ে রেখে নিখোঁজ হন স্বামী। অন্যের বাড়ি কাজ করে তাদেরকে একবেলা খাওয়ালেও দু’বেলা না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আর ঋণ নিয়ে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখনও ৩ মেয়ে রয়েছে, তাদের বিয়ে দেবো কিভাবে? স্বামী থাকলে এমন দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না’।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিখোঁজ রুবেলের মা আমেনা খাতুন বলেন, ‘ছেলেকে বিয়ে দিতে মেয়ে ঠিক করে রেখেছিলাম, আয়োজনও করা ছিলো। কথা ছিলো, মাছ শিকার করে বাড়িতে ফিরলেই আনন্দ-উৎসব করে বিয়ে দেবো। কিন্তু কিছুই হলো না, ছেলে ফিরে এলো না’।
নিখোঁজ জসিমের ভাই নাছির বলেন, ‘ট্রলারডুবির পর থেকে বিভিন্ন স্থানে ভাইয়ের সন্ধান করেছি, কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। ছোট ছোট ৩টি ছেলেকে নিয়ে তার স্ত্রী জেসমিন অন্য কোথাও বিয়ে না বসে আজো স্বামীর প্রতীক্ষায় আছেন’।
গ্রামের খালেক মাঝির ছেলে নিখোঁজ নুরু উদ্দিনের বোন মমতাজ বলেন, ‘যেখানেই থাকুক না কেন, ভাই ফিরে আসবেই। তার মরদেহ পাওয়া যায়নি, তাই তিনি বেঁচে আছেন’।
তিনি বলেন, ‘স্বামীর অপেক্ষা করে নুরুর স্ত্রী রাবেয়া অন্যত্র বিয়ে করেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন দুই ছেলে। তাদের দেখা-শোনা করার কেউ নেই। অসহায় ছেলেদের ভরণ-পোষণের কষ্টে দিন কাটছে আমাদের’।
আনিছ চৌকিদারের ছেলে নিখোঁজ সহিদুলের স্ত্রী আকলিমা বলেন, ‘ছোট্ট শিশুকে রেখে মাছ শিকারে গিয়েছিলেন স্বামী। বলেছিলেন, বাড়িতে ফিরে এসেই নতুন করে ঘর করবেন, সন্তানকে বই কিনে দেবেন। কিন্তু এসবের কিছুই হলো না। তার অপেক্ষায় এখনও পথ চেয়ে আছি’।
নিখোঁজ ইব্রাহিমের বোন নাজমা বলেন, ‘ভাইকে বিয়ে করানোর কথা ছিলো। কিন্তু ফিরে এলেন না, তার কথা মনে করে আজো কেঁদে যাচ্ছি’।
নিখোঁজ মামুনের স্বজন কুলসুমও বলেন, ‘তারা জীবিত ফিরে আসবেন- এ অপেক্ষায় আছি’।
ইউনুস খাঁর ছেলে নিখোঁজ জামাল খাঁর স্ত্রী রোকসানা স্বামীর অপেক্ষায় থেকে থেকে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। তিনি বলেন, ‘অভাব প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। তাই ভবিষ্যৎ ও পেটের টানে বিয়ে করছি’।
তবে স্বজনদের অভিযোগ, সিডরের ঝড়ে নিখোঁজ হলেও সরকার তাদের কোনো সাহায্য করেনি, খোঁজ-খবরও নেননি কেউ’।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ২০১১ সালের পর থেকে জেলে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান প্রকল্পের আওতায় গত তিন বছরে নদী-সাগরে ঝড়-দুর্যোগে নিখোঁজ ও নিহত দুই শতাধিক জেলে পরিবারকে সহযোগিতা করা হয়েছে। এর আগের কোনো জেলে পরিবারের জন্য বরাদ্দ হয়নি। তাই সিডরে নিখোঁজদের পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করা সম্ভব হয়নি। তবে নতুন করে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। সেটি পাস হলেই তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৭
এএসআর