শুধু নিজে নাম নয়; রয়েছে তার বাবা, চাচা, স্ত্রী, মায়ের নামসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নাম। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তীর এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
নিজেকে ‘মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস সংগ্রাহক’ হিসেবে পরিচয়দানকারী এই বিতর্কিত সাংবাদিক আড়ালে সরকারি ভূমির অন্যতম সুবিধাভোগী। দরিদ্র, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে বছরের পর বছর নীতিমালা বহির্ভূতভাবে অবৈধ পন্থায় নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পথে রয়েছেন বিকুল।
এসব অপকর্ম ঢাকতে সম্প্রতি তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক একটি বই সম্পাদনা করে শাসকদলের বড় নেতা-মন্ত্রীকে বশ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বইয়ের সব তথ্য অন্য একটি ওয়েবসাইট থেকে তাদের না জানিয়ে, ক্রেডিট না দিয়ে হুবহু চুরি নিজের নামে চালিয়ে দেন। কিন্তু তাতেও থেকে যায় অসংখ্য ভুল। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে বিক্রি ও বিপণন করা বইটি নিয়ে সোরগোল পড়ে যায়, গোটা জেলাসহ বিভিন্ন মহলে। নড়েচড়ে বসেন প্রশাসনের লোকজনও। পরে এখন কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে সাপ। তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, সরকারি ভূমির প্রতি তার এই লোভ-লালসার শুরু ২০০৫ সাল থেকে। ২০০৫ সালের পর সাংবাদিকতায় অপকর্মের জন্য চাকরি হারিয়েছেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে, বহিষ্কার হয়েছেন শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব থেকে, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্যতা।
যেখানে বনের জায়গা রয়েছে তার
সিলেট বন বিভাগ মৌলভীবাজার রেঞ্জের আওতাধীন সাতগাঁও বন বিটে বিভিন্নভাবে ৪টি অর্থবছরে নিজের এবং পরিবারের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন বিকুল। ২০০৫-২০০৬, ২০০৮-২০০৯, ২০০৯-২০১০, ২০১০-২০১১ অর্থবছর। এখানে দু’টি মহামূল্যবান আগর বাগান ও অন্যান্য বৃক্ষের বাগান রয়েছে।
মৌলভীবাজার রেঞ্জাধীন সাতগাঁও বিটের ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে রোপণ করা মোট ২৮ দশমিক ৮২ হেক্টর আয়তনের বাগানটির উপকারভোগীদের তালিকায় রয়েছেন মোট ২৮জন। এই তালিকার সর্বপ্রথমেই রয়েছে বিকুল চক্রবর্তী নাম। ২ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে বিকুলের বাবা বিকাশ চক্রবর্তী। ৩ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে বিকুলের চাচা বিধান চক্রবর্তীর নাম। বাগানটি সাতগাঁও-দিনারপুর হিল রিভার্জ ফরেস্ট নামে সরকারি খাতায় অন্তর্ভুক্ত।
মহামূল্যবান আগর বাগানটি সৃজন করা হয় ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে। এখানে জমির পরিমাণ ৩০ হেক্টর আর উপকারভোগীর তালিকায় রয়েছেন ৩৬ জন। এই তালিকার ১৪ নম্বর সারিতেই বিকুলের স্ত্রী চৈতালি চক্রবর্তীর নাম। তারপর ১৫ নম্বর সারিতে রয়েছে বিকুলের মা পূর্ণিমা রাণী চক্রবর্তীর নাম। এই বাগানটিও সাতগাঁও-দিনারপুর হিল রিভার্জ ফরেস্ট নামে পরিচিত।
২০০৯-২০১০ সালে সৃজন করা ১০ হেক্টরের বাগান সাতগাঁও বিটে অবস্থিত ন্যাড়া পাহাড়। এই বাগানের মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ২৫ জন। এই তালিকার ৭ নম্বর সারিতে রয়েছেন বিকুল চক্রবর্তী।
২০১০-২০১১ সালে সৃজিত ২৫ হেক্টরের মহামূল্যবান আগরবাগানটি মোট উপকারভোগী মোট ৬২ জন। এই তালিকার ৩৮ নম্বর সারিতে বিকুল চক্রবর্তী ও ৪১ নম্বর সারিতে রয়েছে বিকুলের চাচা বিধান চক্রবর্তীর নাম। সাতগাঁও-দিনারপুর হিল রিভার্জ ফরেস্ট মৌজা হিসেবে এ বাগানটি পরিচিত।
সরেজমিনে যা দেখা যায়
বুধবার (৮ নভেম্বর) দুপুরে মৌলভীবাজার রেঞ্জের সাতগাঁও বিটের ২০০৮-২০০৯ সালে সৃজন করা ৩০ হেক্টরের আগরবাগানে গিয়ে দেখা যায় মাঝারি আকারের আগরগাছগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। নিচে রয়েছে আনারস গাছের সারি। যতখানি একালাজুড়ে আগরগাছ ততখানিতে আনারসের চাষ। এটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। বাইসাইকেল বা গাড়ি কিছুই এখানে চলাচলা করে না।
বাগানের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ৩০ হেক্টরের আগরবাগান। অথচ বনবিভাগের কাগজপত্রে লেখা ২৮ দশমিক ৮২ হেক্টর। চারার সংখ্যায় লেখা রয়েছে ৩৯ হাজার ৯০০টি। একটি আগর গাছ থেকে অপর আগর গাছের দূরত্ব ৯ ফুট।
‘এই সামাজিক বনায়নে ব্যক্তি কীভাবে লাভবান হয়’ -এই প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনবিভাগের এক কর্মী বলেন, মনে করেন, এই বাগানের উপকারভোগী ২১ জন আর আগর চারার সংখ্যা ৩০ হাজার। প্রায় ১৪/১৫ বছর পর এই আগরগাছগুলো কাটা হলে গাছ প্রতি বিক্রয়মূল্য আসবে ১০ হাজার টাকা হারে সর্বমোট ৩০ কোটি টাকা।
এই ৩০ কোটি টাকার মধ্যে বন অধিদপ্তর পাবে ৪৫ শতাংশ, উপকারভোগীরা পাবেন ৪৫ শতাংশ এবং বৃক্ষরোপণ তহবিল পাবে ১০ শতাংশ। এই হারে এই আগরবাগানের বন অধিদপ্তর আনুমানিক ১৩ কোটি ৫০ লাখ এবং ২১ জন উপকারভোগী পাবেন আনুমানিক ১৩ কোটি ৫০ লাখ করে। ২১ জনে জনপ্রতি ৬৪ লাখ ২৮ হাজার টাকার হারে পাবেন। মোট বিক্রির লভ্যাংশের ১০ শতাংশ হারে বন অধিদপ্তরের বৃক্ষরোপণ তহবিলে যাবে ৩ কোটি টাকা।
তিনি আরও বলেন, এই জায়গাটি বিধান চক্রবর্তী (বিকুলের চাচা) শ্রীমঙ্গল থেকে এখানে এসে নিয়মিত দেখাশোনা করেন। মাধব রায় নামে স্থানীয় এক শ্রমিককে এ জমিটি দেখাশোনার জন্য রেখেছেন।
এই বাগান থেকে পরবর্তী বাগানের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। হাঁটা পথ। এটি অতি দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। পানিপূর্ণ ছড়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। একেবারেই জনমানবহীন নির্জন এলাকা। ২০১০-২০১১ সালের সৃজিত আগরবাগানে পৌঁছাতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। এখানে ২৫ হেক্টরের বাগানে রোপিত আগরচারার সংখ্যা ৩৩ হাজার ২৫০টি। এখানে শুধু আগরই নয়, রয়েছে মহামূল্যবান সেগুন গাছ। আর নিচে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চাষ হচ্ছে আনারস।
নীতিমালায় যা রয়েছে
সামাজিক বনায়ন বিধিমালার অন্যতম উল্লেখ্যযোগ্য শর্তই হলো চিহ্নিতকরণ জায়গাটি থেকে ১ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসরত ভূমিহীন, দরিদ্র, কৃষি শ্রমিক, ৫০ শতাংশের কম ভূমির মালিক, দুস্থ নারী, অনগ্রসর গোষ্ঠী, দরিদ্র আদিবাসী, দরিদ্র ফরেস্ট ভিলেজার ও অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযোদ্ধার অস্বচ্ছল সন্তানকে উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচন করতে হবে।
যদি এক বর্গ কিলোমিটার মধ্যে উপকারভোগী না পাওয়া যায় তবে এক বর্গ কিলোমিটারের নিকটতম এলাকা প্রায় দেড়-দুই বর্গকিলোমিটারের মধ্যে গিয়ে উপকারভোগী নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু সাতগাঁও বিট থেকে বিকুল চক্রবর্তীর অবস্থান প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। শ্রীমঙ্গল শহরের সবুজবাগ আবাসিক এলাকায়। এর কোনো ক্যাটাগরিতেই বিকুল পড়েন না।
যেসব কর্মকর্তারা বিধি লংঘন করেছেন
২০০৫-২০০৬ সালের ২৮ দশমিক ৮২ হেক্টরের ২৮ জন উপকারভোগীর তালিকাটিতে তৎকালীন সাতগাঁও বিট কর্মকর্তা এসএম সাইদুর রহমান, মৌলভীবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রায় চৌধুরী এফআর, সহকারী বন সংরক্ষক আবু নাসের মোহসিন হোসেনের স্বাক্ষর রয়েছে।
২০১০-২০১১ সালের আগর বাগানের ৬২জন উপকারভোগীর তালিকাটিতে তৎকালীন সাতগাঁও বিট কর্মকর্তা মনিরুল করিম, মৌলভীবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা মহসিন মিয়া, সহকরী বন সংরক্ষক এজেডএম হাসানুল রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে।
২০০৮-২০০৯ সালের ৩০ হেক্টরের আগর বাগানের ৩৬ জন উপকারভোগীর তালিকাটিতে তৎকালীন মৌলভীবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রায় চৌধুরী এফআর, সহকরী বন সংরক্ষক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের স্বাক্ষর রয়েছে।
২০০৯-২০১০ সালের ন্যাড়া পাহাড় এলাকায় ১০ হেক্টরের ২৫ জন উপকারভোগীর তালিকায় মৌলভীবাজার রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবুল হাসেম এফআর এর স্বাক্ষর রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
২০০৮-২০০৯ সালে ৩০ হেক্টরের আগরবাগনের একজন উপকারভোগী সলিল মাহান্তী বাংলানিউজকে বলেন, ৩৬ জনের তালিকায় কয়েকজন অনেক দূর থেকে এসে এই তালিকায় ঢুকেছেন। এরা এক বা দুই বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে নেই। এদের নাম ঢুকিয়ে এলাকার সাঁওতাল, ওরাংসহ প্রকৃত ভূমিহীন ও গরিব মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আরএসএম মুনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কোনো এলাকায় সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে যদি নীতিমালা মানা না হয় তবে উপকারভোগী ম্যানেজমেন্ট কমিটির মতামতের ভিত্তিতে উপজেলা এবং জেলা বন উন্নয়ন কমিটিতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত আনা যেতে পারে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সামাজিক বনায়নের নীতিমালা লংঘন প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, এলাকার দরিদ্র, হতদরিদ্র কিংবা আধাদরিদ্র লোকজনদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আমাদের এ কার্যক্রম চালু রয়েছে। নীতিমালা যদি না মেনে এখানে উপকারভোগীর তালিকা করা হয়, তবে এ ব্যাপারে তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিকুলের ভুলে ভরা বই শিক্ষার্থীদের হাতে
‘আপন আলোয় বিশ্ব ভুবন’ বিকুলের চৌর্যবৃত্তি!
বিকুলের ভুলে ভরা বই জব্দ করেছে প্রশাসন
বঙ্গবন্ধু নিয়ে ভুলেভরা বইয়ের ভোল পাল্টে চালাকি বিকুলের
শিক্ষকরা না পড়েই স্কুলে বিক্রি! জব্দ আরও ৪৭৭ বই
এবার আলাউদ্দিন স্কুল থেকে জব্দ হচ্ছে বিকুলের বই
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৭
বিবিবি/এএ