ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রানা প্লাজা ট্রাজেডি

এখনও নিভৃতে কাঁদেন নিলুফা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৯
এখনও নিভৃতে কাঁদেন নিলুফা রানা প্লাজা ধসে পঙ্গু হয়ে যাওয়া নিলুফা

সাভার (ঢাকা): ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলে ঘটেছিলো পৃথিবীর ইতিহাসের তৃতীয় বৃহত্তম হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। রানা প্লাজার নয় তলা ভবন ধসে নিহত হয়েছিলেন ১১৩৪ জন আর আহত হয়েছিলেন কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিক। সেদিন স্বজনহারা ও আহতদের অর্তনাতে ভারী হয়েছিলো সাভারের বাতাস। 

সেই দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করে যারা বেঁচে আছেন তাদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনের ফিরতে পারেননি বিগত ছয় বছরেও। সেই দিনের বিভীষিকাময় দুর্ঘটনার স্মৃতি আজো তাড়া করছে তাদের।

একদিকে কাজের অক্ষমতা অন্যদিকে শারীরিক ক্ষত আর অভাবে নিদারুণ কষ্টে আছেন উদ্ধারকর্মীদের তৎপরতায় ধ্বসে পড়া ভবনের নিচে থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিকদের অনেকেই।

দুর্ঘটনার স্মৃতি ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে বেঁচে ফেরা এসব নিম্ন আয়ের পোশাক শ্রমিকদের তাড়া করে ফেরে আজো। এমনি এক আহত শ্রমিক নিলুফা বেগমের সন্ধান মেলে সাভারের রাজাশন এলাকার একটি শ্রমিক পল্লিতে। শ্রমিক পল্লির ছোট্ট টিনশেডের ঘরটিতে ঘুটঘুটে অন্ধকার ও ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বিছানায় বসে থাকতে দেখা গেলো তাকে। এছাড়া যে উপায়ও নেই তার। কারণ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে আহত হয়ে পঙ্গুত্বসহ নানা শারীরিক সমস্যাকে বরণ করে নিতে হয়েছে তাকে।  

রানা প্লাজা ধসে তার ডান পা চাপা পড়েছিলো ধসে পড়া বিমের নিচে। দুর্বিসহ সেই ঘটনায় তার শরীরে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে সেই যন্ত্রণা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। এমনটা বলতেই চোখে পানি চলে আসে নিলুফার। কাঁদতে কাঁদতে সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে আগের সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা জীবনের স্মৃতিপটে ফিরে যান তিনি।

কি হয়েছিলো সেদিন তার? কেনই বা তাকে বিছানায় পড়ে থেকে কাতরাতে হচ্ছে এমন প্রশ্নে অপলক নয়নে তাকিয়ে থেকে উত্তর দেয় অসহায় নিলুফা।
তিনি বলেন, তিনি রানা প্লাজার পঞ্চম তলায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। ভবনটিতে ফাটল দেখা দেওয়ার পর তা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলেও মালিকপক্ষ সেদিন শিপমেন্টের জন্য তাদের কাজ করতে বাধ্য করে। ২৪ এপ্রিল সেলাই মেশিনে কাজ করার সময় হঠাৎ যেন চারিদিক ধুলোয় অন্ধকার হয়ে যায়। ভবনের নিচে চাপা পড়া অনেক মানুষের আর্তচিৎকার ভেসে আসতে থাকে তার কানে। চোখ মেলে দেখেন তার মাথার উপরের ছাদটি ধসে পড়েছে। শরীরের উপর পড়ে আছেন একই ফ্লোরের আরেক সহকর্মী। কিন্তু তার মাথা ও শরীরের একাংশ নিজের গায়ের উপর থাকলেও বাকি অংশ চাপা পড়ে আছে ভবনের নিচে। নিজের একটি পা আটকে আছে ধসে পড়া বিমের নিচে। কী করবেন? এমন চিন্তা  ও উপরওয়ালাকে ডাকতে সময় পেরিয়ে বিকেল গড়িয়ে এলো। এমন সময় বাইরে থেকে উদ্ধারকর্মীদের কেউ একজন আওয়াজ দিলে সাড়া দেন তিনি। পরে বিকেলেই তাকে সেখান থেকে বের করে আনা হয়। কিন্তু বিমের নিচে চাপা পড়ে থেতলে যায় তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের দিকের প্রায় এক ফুট অংশ।  

নিলুফা জানান, আহত অবস্থায় প্রথমে সাভারের গণস্বাস্থ্য, এনাম মেডিকেল ও পরবর্তীতে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে পর্যায়ক্রমে প্রায় দুই মাস চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার দুইটি কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়ে। একই সাথে চোখের সমস্যাসহ মানসিক রোগেও আক্রান্ত হন তিনি। পরে কিছুদিন মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। পাশাপাশি পায়ের ক্ষত দিন দিন বাড়তেই থাকে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া ও ক্ষত পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। ইতোমধ্যে সরকারের দেওয়া অনুদানের সাড়ে তিন লাখ টাকাসহ নিজের শেষ পুঁজিটুকু পর্যন্ত চিকিৎসার কাজে এই তিন বছরে ব্যয় করেন নিলুফা। কিন্তু সেই সময় পা কেটে ফেলতে রাজি হননি তিনি। তাকে জানানো হয়, যদি তিনি পা কেটে ফেলেন তাহলে ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। রাজি না হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে আসেন নিলুফা। এরপর থেকে এতদিন কেটে গেলেও কেউ খোঁজ-খবর নেয়নি তার। দিনে দিনে ক্ষত বেড়ে এখন স্ক্র্যাচ ছাড়া চলতে পারেন না নিলুফা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিলুফা জানান, দীর্ঘ ২ বছর ধরে পায়ের ক্ষতের যন্ত্রণায় রাতে ঘুম পর্যন্ত হয় না। শরীরে বেড়ে যাওয়া অন্যান্য সমস্যাগুলোর কারণে সংসারের কাজও করতে পারেন না তিনি। দিনমজুর স্বামী শহীদ তার দেখভালের জন্য রং মিস্ত্রির কাজ ছেড়ে বাড়ির কাছেই ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দিয়ে বসেছেন। কিন্তু এতে দুই সন্তান নিয়ে তাদের বেঁচে থাকা এখন খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। পরিবারের এই করুণ অবস্থা, নিজের শারীরিক যন্ত্রণা ও দুর্ঘটনার স্মৃতি মনে করে প্রতিদিনই অঝোরে চোখের জল ফেলে বুক ভাসান নিলুফা।

হয়তো এক সময় ক্ষতিপূরণ না পেয়ে চিকিৎসার অভাবে এভাবেই ধুঁকে ধুঁকে চোখের জল ফেলে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে নিলুফা। এরকম আরো কতো রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে আহত নিলুফা চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারাবে জানতেও পারবো না আমরা। আর স্বজন হারিয়ে বিলাপ করবে তার পরিবার। এতিম হবে কত সন্তান। যেসব খবর হয়তোবা আসবে না পত্রিকার পাতায়। কিন্তু তাদের আর্তনাদ ভেসে বেড়াবে আকাশে বাতাশে।

বাংলাদেশে সময়: ১০৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৯
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।