ঢাকা, বুধবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আলোচিত ৭ খুনের ৫ বছর

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৯
আলোচিত ৭ খুনের ৫ বছর

নারায়ণগঞ্জ: বহুল আলোচিত ৭ খুনের নৃশংসতা শুধু নারায়ণগঞ্জবাসীকেই নয় পুরো বিশ্ববাসীকেও নাড়া দিয়েছিলো। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছিলো সেই খবর। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট ফোর্স র‌্যাব সদস্যদের সম্পৃক্ততায় ন্যক্কারজনক সেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

হত্যাকাণ্ডের ৫ বছর পূর্ণ হলেও বাস্তবায়ন হয়নি আদালতের রায়। নিম্ন আদালতের পরে হাইকোর্টেও দ্রুত রায় ঘোষণা করা হলেও আপিল বিভাগে রায়টি নিষ্পত্তি হতে ধীরগতির অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণের সেই ঘটনা এখনো ভুলতে পারেননি রাজধানী লগোয়া শীতলক্ষ্যা তীরের মানুষ। সেদিন নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেটকারযোগে ফিরছিলেন নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। একই সময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেটকারে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম।

পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদা পোশাক পরিহিত র‌্যাব সদস্যরা তাদের ৭ জনকেই অপহরণ করেন। ৭ জনকে অপহরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ।  

দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।  

৭ জনকে হত্যায় একই কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই স্টাইলে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। যাতে করে লাশ ভেসে উঠতে না পারে। উদ্ধার করা মরদেহের সবগুলোরই হাত-পা বাঁধা ছিলো, পেটে ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইট ভর্তি সিমেন্টের বস্তার দুটি বস্তা বেঁধে দেওয়া হয় প্রতিটি মরদেহের সঙ্গে। প্রতিটি মরদেহে মুখ ছিলো পলিথিন দিয়ে মোড়ানো।  

মামলা চলাকালে প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামিদের চোখ রাঙানি, নরঘাতকদের পক্ষে আদালতপাড়ায় শোডাউনসহ নানা ঘটনায় গেল পৌনে ৩ বছর ধরেই আলোচিত ছিল ৭ খুনের মামলাটি।  

তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। দুটি মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৩ জন কারাগারে আটক রয়েছেন। আর চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে এখনো ১২ জন পলাতক রয়েছে।  

২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। দুটি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী হলেন ১২৭ জন করে। এর মধ্যে দুটি মামলার বাদী, দু’জন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানো ও তাদের বক্তব্য গ্রহণের কার্যক্রম। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। গত ৩০ নভেম্বর শেষ হয় আলোচিত সাত খুন মামলার আইনি কার্যক্রম।

২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৪মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ অধিনায়ক মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও লাশ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামিকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ জনকে ১০ বছর এবং লাশ গুমে জড়িত থাকায় ২ জনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

পরবর্তীতে ২০১৭ সালেল ২২ আগস্ট সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র‍্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রায়ে যে ২৬ জনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত তাদের মধ্যে প্রধান চার আসামি সহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড তথা ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি ১১ জনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ফাঁসি ১৫ জনের
২২ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- প্রধান আসামি নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (পলাতক), সৈনিক আলামিন শরিফ (পলাতক) ও সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক)।

যাবজ্জীবন ১১ জনের
১১ জনকে ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলেও ২২ আগস্ট হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তারা হলেন— র‌্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, জামালউদ্দিন, এনামুল কবীর, সানাউল্লাহ সানা (পলাতক), শাহজাহান (পলাতক)।

৯ জনের কারাদণ্ড
৯ জনকে নিম্ন আদালতের  দেওয়া বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড রায় ২২ আগস্ট হাইকোর্ট বহাল রেখেছেন। অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর, কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে।

এদিকে নিম্ন আদালতে ও হাইকোর্ট মামলাটির কার্যক্রম দ্রুত চলমান থাকলেও আপিল বিভাগে মামলাটির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা। অপরদিকে মামলাটির রায় দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নরঘাতকদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

৭ খুনে নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, আলোচিত ৭ খুনের পরে নারায়ণগঞ্জে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির রায় ঘোষণার পরে হাইকোর্টেও মামলাটির রায় দ্রুত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগে মামলাটির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। যে কারণে আমরা বর্তমানে মামলাটির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় আছি।

আদমজী এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন শুধু জাতীয় পর্যায়েই নয় আন্তর্জাতিকভাবেও আলোচিত হয়েছিল। এই ৭ খুনের ঘটনার নৃশংসতায় শিউরে উঠেছিল জাতি। আমরা দ্রুত এই ৭ খুনের মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের রায় কার্যকর চাই।

হিরাঝিল এলাকার বাসিন্দা শরীফ হোসেন বলেন, নূর হোসেনের নির্দেশে দেশের একটি এলিট ফোর্সের বিপথগামী সদস্যরা আলোচিত ৭ খুনের মাধ্যমে দেশে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত করেছিল। তাই এই আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। এজন্য সরকারের কাছে আমাদের আবেদন দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের রায় বাস্তবায়ন করা হোক।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৯
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।