ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আইলার ১০ বছর: খাবার পানি ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের সংগ্রাম

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৯
আইলার ১০ বছর: খাবার পানি ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের সংগ্রাম

সাতক্ষীরা: ভয়াল ২৫শে মে। ২০০৯ সালের এদিনে প্রলয়ংকারী জলোচ্ছ্বাস আইলায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা উপকূলীয় এলাকা। ১৫ ফুট উচ্চতায় ধেয়ে আসা এ জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায়। এতে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৭৩ জনের প্রাণহানি হয় । গৃহহীন হয়ে পড়ে কয়েক হাজার পরিবার। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধও। লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ও পদ্মপুকুর। 

আইলার পর প্রায় দশ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলের মানুষ। কাজ, খাবার ও সুপেয় পানির অভাবে আইলায় বিধ্বস্ত উপকূলীয় জনজীবন দিনকে দিন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

টিকে থাকতে না পেরে অনেকেই চলে যাচ্ছেন অন্যত্র। প্রতিনিয়ত বেড়িবাঁধ ভাঙনে বাড়ছে গৃহহীনের সংখ্যা।  

আইলা দুর্গত গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, খুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে বাস করছেন গৃহহীন হয়ে পড়া মানুষগুলো। লবণাক্ততার কারণে কৃষিকাজ নেই বললেই চলে। কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে এলাকা ছাড়ছেন অনেকেই। বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় জনপদ। সুপেয় পানির জন্য চলছে চরম হাহাকার। কোনোমতে দূর-দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করে জীবন চলছে তাদের। নেই সুচিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা।  

বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট গোটা উপকূলজুড়ে। প্রচণ্ড লবণাক্ততায় জনপদ বৃক্ষরাজি শূন্য হয়ে পড়েছে। জ্বালানি, খাবার পানি ও কর্মসংস্থানের সংকট মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লোনা পানির চিংড়ি চাষ।

লবণাক্ততা মোকাবিলা করে কোনো কোনো জমিতে ধান চাষ সম্ভব হলেও অধিকাংশ কৃষি জমিই রয়েছে অনাবাদী। কাজ ও জ্বালানি সংকটের কারণে সুন্দরবনের উপর চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। সেই সঙ্গে বেড়েছে রোগ-শোক, অপুষ্টি, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক প্রবণতা ও শিশু শ্রম।  

গাবুরা ইউনিয়নের আবু মুছা বাংলানিউজকে বলেন, এলাকায় কোনো কাজ নেই। লবণ পানির চিংড়ি চাষ যত বাড়ছে, কাজ তত কমে যাচ্ছে। লবণ পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ না হলে এই জনপদের মানুষ না খেয়ে মরবে। এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারবে না।  

পদ্মপুকুরের জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ এখনো ঠিকমত সংস্কার করা হয়নি। যতদিন স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করা হবে, ততদিন আইলার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে না। বার বার বাঁধ ভেঙে আমাদের সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। এলাকায় লবণ পানি ঢুকলে ফসল হয় না। আর খাওয়ার পানিও থাকে না।  

খাবার পানি আনতে দূর-দূরান্তে যাচ্ছেন স্থানীয়রা।

আবেগাপ্লুত হয়ে চাদনীমুখা গ্রামের আবু সিদ্দিক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের নিরাপদ জীবনের জন্য সবার আগে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বাঁধ হলে যার যতটুকু সম্পত্তি আছে তাতেই ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকতে পারবো। মিষ্টি পানির পুকুরগুলো আর নষ্ট হবে না। সেই পানি খেয়েই বাঁচবে মানুষ। পানি কিনে খেয়ে কি জীবন চলে?

স্থানীয় পরিবেশ গবেষক পিযুষ বাউয়ালী পিন্টু বাংলানিউজকে বলেন, এলাকায় মানুষের মধ্যে তীব্র অপুষ্টি বিরাজ করছে। আইলায় খাদ্য নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়েছে। বর্তমানে কৃষকরা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে লবণাক্ততা মোকাবিলা করে আবার ধান চাষের চেষ্টা করছেন। তাদের এ প্রচেষ্টায় সরকার সহযোগিতা না করলে কোনোদিনও তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য স্থানীয় সরকারি খালগুলোর বন্দোবস্ত বাতিল করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ ও জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকায় কিছু ফলাতে হলে এর দ্বিতীয় আর কোনো বিকল্প নেই।  

শ্যামনগর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বাংলানিউজকে জানান, গোটা উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট। মানুষ পুকুরের পানি খেয়ে বেঁচে থাকে। তাও পাওয়া যায় না। তাই খাবার পানির সংকট নিরসনে এলাকার পুকুর-জলাশয়-জলাকারগুলো পুনঃখনন পূর্বক ব্যবহার উপযোগী ও মিষ্টি পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি যতদূর সম্ভব লোনা পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। লোনার কারণে মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে আইলায় বিধ্বস্ত দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চেয়ারম্যান মাকসুদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, শুধু গাবুরা নয়, উপকূলীয় লাখ লাখ মানুষের নিরাপদ জীবনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ। বার বার বাঁধ ভেঙে আমাদের সব অর্জন ম্লান করে দিয়ে যায়। খাবার পানিটুকুও থাকে না।  

শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আতাউল হক দোলন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এলাকার উন্নয়নের জন্য সবারে আগে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সুপেয় খাবার পানি নিশ্চিত করার দরকার। সরকার শ্যামনগর এলাকার জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। আশা করছি, খুব দ্রুত বেড়িবাঁধ নির্মাণে কাজ শুরু হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৯
এসএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।