ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পরিত্যক্ত পলিথিন-প্লাস্টিকে জ্বালানি তেল-গ্যাস

ফজলে ইলাহী স্বপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১৯
পরিত্যক্ত পলিথিন-প্লাস্টিকে জ্বালানি তেল-গ্যাস পলিথিন পুড়িয়ে তেল-গ্যাস উৎপাদন করছেন রোস্তম/ছবি: বাংলানিউজ

কুড়িগ্রাম: বদ্ধ ড্রামের ভিতর আগুনে গলছে পরিত্যক্ত পলিথিন। তরল গলা সে পলিথিন বাষ্পীভূত হয়ে পাইপ দিয়ে বের হচ্ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। পরে পরিশোধিত হয়ে বোতল-জেরিকেনে বিন্দু বিন্দু করে জমে তৈরি হচ্ছে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও এলপি গ্যাস। 

ফেলে দেওয়া পরিত্যক্ত প্লাস্টিক আগুনে গলিয়ে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল, এলপি গ্যাস তৈরির মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার রোস্তম আলী নামে এক শিক্ষার্থী। ডিপ্লোমা পাস করে অনলাইন কোর্সে ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশে (আইইবি) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বর্তমানে অধ্যায়নরত।

শুধু জ্বালানিই নয়, অবশিষ্ট পলিথিনের ছাই থেকে ফটোকপি মেশিনের কালি তৈরির গবেষণাও করছেন এই যুবক।

এই অভিনব জ্বালানি তেল-গ্যাস আবিষ্কার দেখতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন উমর মজিদ ইউনিয়নের বালাকান্দি গ্রামের রোস্তম আলীর বাড়িতে। ইতোমধ্যে তার অভিনব উদ্ভাবনী দেখে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।

বালাকান্দি গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিজ বাড়ির সামনেই একটি বদ্ধ তেলের ড্রামের সঙ্গে পাইপের মাধ্যমে একটি বোতল ও দু’টি জেরিকেনের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ড্রামের ভিতর প্লাস্টিক ও পলিথিন ভরে ড্রামের মুখ বন্ধ করে নিচে আগুন জ্বালিয়ে তা গলানো হচ্ছে।  

জ্বলছে পলিথিন থেকে উৎপাদিত এলপি গ্যাসপ্রায় ২৫/৩০ মিনিট ধরে উচ্চতাপ প্রয়োগে প্লাস্টিকগুলো পুরোপুরি গলে বাষ্প আকারে পাইপের মাধ্যমে বোতলে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকে। এভাবেই বাষ্পীভূত হয়ে বিন্দু বিন্দু আকারে বোতল ও জেরিকেনে জমছে ডিজেল-পেট্রোল-অকটেন। জেরিকেনের সঙ্গে অপর একটি পাইপের মাথা দিয়ে বেরিয়ে আসছে এলপি গ্যাস। যা ড্রামের তলায় দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে অন্য কোনো জ্বালানি ছাড়াই গলানো হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন।
 
রোস্তম আলী পরিত্যক্ত প্লাস্টিক-পলিথিন থেকে উৎপাদিত জ্বালানি তেল নিজস্ব মোটসাইকেলে ব্যবহার করার পাশাপাশি গ্রামবাসী, স্বজন-বন্ধু বান্ধবদেরও দিচ্ছেন ব্যবহারের জন্য। জনসম্মুখে তার আবিষ্কৃত জ্বালানি অকটেন, পেট্রোল মাটি ও পানিতে ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালানি প্রমাণ করে দেখানোয় ব্যতিক্রমী এ উদ্ভাবন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এলাকায়।  

রোস্তম আলী বাংলানিউজকে বলেন, ছোটবেলায় শীত থেকে রক্ষা পেতে গ্রামের মানুষ খড়কুটোর পাশাপাশি প্লাস্টিক পোড়ালে ফোঁটা-ফোঁটা আকারে কিছু পদার্থ বের হতো। সেখান থেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রায় তিন বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছি। ২০১৭ সালে টিনের ছোট কৌটায় কিছু প্লাস্টিক গলিয়ে তরল পদার্থ বের করে শোধন করার পরীক্ষা চালিয়ে দেখি ডিজেল ও পেট্রোল জাতীয় তরল পদার্থ বের হয়ে আসছে।  

উৎপাদিত জ্বালানি ভরে রাখা হয়েচে বোতলেতিনি বলেন, এভাবেই শুরু হওয়া উৎপাদিত জ্বালানি তেল দু’টি পদ্ধতিতে পরিশোধন করা হয়। এক ছাকন পদ্ধতি এবং দুই থিতানো পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পরিষ্কার এক কেজি প্লাস্টিকে ৯শ গ্রাম তেল এবং অপরিষ্কার প্লাস্টিক থেকে ৬/৭শ গ্রাম জ্বালানি তেল উৎপাদিত হয়। এতে খরচ হয় মাত্র ৩০ টাকা। এই তরল পদার্থগুলো হাইড্রোকার্বন ও এগুলোর ধর্ম এবং বর্ণ ডিজেল-পেট্রোল-অকটেন এবং নির্গত এলপি গ্যাসের মতো।  

সরকারি-বেসরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে দেশের জ্বালানি খরচে নতুন মাত্রা যোগ করার পাশাপাশি প্লাস্টিকের অপব্যবহারে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও জানান রোস্তম আলী।
 
রোস্তম আলীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, রাজারহাট উপজেলা উমর মজিদ ইউনিয়নের বালাকান্দি গ্রামের কৃষক মৃত মফিজুল হকের ছোট ছেলে রোস্তম আলী (২২)। মাত্র চার বছর বয়সেই বাবাকে হারানো রোস্তম পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। মাত্র ১৪ শতক জমিতে বসতবাড়ি ছাড়া কিছুই নেই। বড় ভাই ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করেন। ২০১৩ সালে পান্থাবাড়ি বালাকান্দি দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে অভাবের সংসারে কোনোমতে কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন।  

২০১৭ সালে ডিপ্লোমা পাস করে অনলাইন কোর্সে ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশে (আইইবি) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বর্তমানে অধ্যায়নরত। বড় ভাইয়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরতে টিউশনির পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণার কাজ।  

স্থানীয় অধিবাসী আকবর আলী, মজিবর রহমানসহ অনেকেই বাংলানিউজকে জানান, এই অভিনব পদ্ধতিতে জ্বালানি আবিষ্কার করায় এলাকা পরিত্যক্ত পলিথিন শূন্য হয়ে পড়েছে। আমরা একবছর ধরে রোস্তমের কাছে তেল নিয়ে কাজে লাগাচ্ছি। সরকারি/বেসরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে আরও ব্যাপক সুফল পাবে এলাকাবাসী।  

রাজারহাট উপজেলার পান্থাবাড়ি বালাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধনেশ্বর চন্দ্র বর্ম্মণ বাংলানিউজকে বলেন, রোস্তম আলী আমার স্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। অভাব-অনটনের সংসারে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। আমরাই ভাবতে পারিনি সে এমন ব্যতিক্রমী একটা আবিষ্কার করে সাড়া ফেলবে। উচ্চমহলের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অনেক দূর এগোবে বলে আমার বিশ্বাস।
 
রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহ: রাশেদুল হক প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, আমি নিজেই দেখেছি রোস্তমের আবিষ্কার। দেশে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। তবে রোস্তমের আবিষ্কারটা একটু ব্যতিক্রম মনে হয়েছে আমার কাছে। কেননা সে একই প্লাস্টিক পুড়িয়ে সেখান থেকে ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল ও এলপি গ্যাস উদ্ভাবন করেছে। এ বিষয়ে রোস্তম আলী যে ধরনের সহযোগিতা চাইবে আমি ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই সহযোগিতা করবো।  

বাংলাদেশ সময়: ১১১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৯
এফইএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।