সিলেট রুটে টেনের সেবা এমন যেনো, রেল কর্তৃপক্ষ সিলেটের যাত্রীদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছেন, এমন অভিযোগ বিশিষ্ট জনেরও। কারণ বিগত দিনে সিলেট রুটে আন্তঃনগর ট্রেনের কোচ কেটে নেওয়া হয়েছিল।
ডিও লেটারে সিলেট রুটের আন্তঃনগর ট্রেনে কোচ বাড়ানো হয়েছে ঠিক। তবে সেগুলো জরাজীর্ণ। যেগুলো অন্য রুটের লোকাল ট্রেনের সমমান! তাছাড়া এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ঈদেও বিশেষ ট্রেন তো দূরে থাক, অতিরিক্ত কোচ সংযোগও দেওয়া হয় না।
ট্রেনের কোচের জরাজীর্ণ অবস্থা দৃশ্যমান হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় চট্রগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ‘তূর্ণা নিশীথা’র সঙ্গে সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া উদয়ন এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর।
দুর্ঘটনায় তূর্ণা নিশীথার তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও উদয়নের কোচগুলো লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এরপর থেকে সিলেটের মানুষের মনে একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, কতটা জরাজীর্ণ কোচ নিয়ে চলাচল করে সিলেট রুটের ট্রেন?
প্রতিদিনের মতোই ১৬টি কোচ নিয়ে সোমবার (১১ নভেম্বর) রাত ৯টায় সিলেট স্টেশন ছেড়ে যায় উদয়ন এক্সপ্রেস। পরে রাত ৩টার দিকে তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারায় ১৬ জন। নিহত ১৬ জনই উদয়নের এক্সপ্রেসের যাত্রী।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সস্তা মূল্যের কোচ দিয়ে সিলেট রুটে ট্রেনসেবার নামে এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। যাত্রীসেবার মান এতোই নিচে নেমেছে যে, এখন অন্য রুটের লক্কড়-ঝক্কড় কোচ দিয়ে সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রয়েছে। নয়তো, ঘুর্ণিঝড়েও এতো মানুষ মরেনি, যত মরেছে এক ট্রেন দুর্ঘটনায়।
অচিরেই সিলেট রুটের রেলের জরাজীর্ণ লাইন সংস্কার ও আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে নতুন কোচ দেওয়ার জোরদাবি জানান মেয়র আরিফুল।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসাবহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, সিলেট রুটে ট্রেনসেবার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। বিগত দিনেও যাত্রীদের বিভিন্ন অভিযোগ মিলেছে। অচিরেই আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে নতুন কোচ সংযোগ ও ডাবল রেললাইন করার দাবি জানাচ্ছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সনাক) সিলেট শাখার সমন্বয়ক ফারুক মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, দেশের অন্য রুটে চলাচল করা লোকাল ট্রেনের কোচের স্ট্যান্ডার্ডে (মানের) সিলেট রুটে আন্তঃনগর ট্রেনের কোচ। সব লক্কড়-ঝক্কড়। যে কারণে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশি। বিগতদিনে ট্রেনের কোচগুলোও কমিয়ে আনা হয়েছিল। এরপর সাবেক অর্থমন্ত্রীর ডিও লেটারের পরিপ্রেক্ষিতে কোচ বাড়ানো হলেও, মান বাড়ানো হয়নি। এরজন্য কেবল ডিও লেটার নয়, ট্রেনসেবায় তদারকিরও প্রয়োজন ছিল।
ট্রেন দুর্ঘটনার নিহতদের প্রতি শোক জানিয়ে সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব বাংলানিউজকে বলেন, সিলেট রুটে ট্রেনের সেবা নিয়ে আমরা হতাশ। অন্য রুটের নড়বড়ে কোচ মেরামত করে সিলেট রুটের ট্রেনে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ট্রেনগুলোতে নতুন কোচ সংযোগ ও ব্রডগেজ লাইন স্থাপনে এরইমধ্যে আমরা চেম্বার থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কেননা, আমাদের সিলেটের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও ভালো না। আগে রেলপথ নিরাপদ মনে করা হতো। কিন্তু এখন একের পর এক দুর্ঘটনায় রেলপথ থেকেও আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় তূর্ণা নিশীথার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু পুরনো কোচ হওয়ায় উদয়নের কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা দৃশ্যমান।
লক্কড়-ঝক্কড় কোচের কারণেই আন্তঃনগর উদয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমনটি জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, এই রুটে নিম্নমানের রেলসেবার প্রমাণ দেয় সিলেট স্টেশনের অভ্যন্তরে যাত্রীদের অপেক্ষমান ৭৭টি স্টিল, প্লাস্টিক ও সোফার বসার চেয়ার। এগুলোর অধিকাংশ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। বাধ্য হয়ে সেসব চেয়ারেই বসছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের অনেকের অভিযোগ, দীর্ঘ কয়েক বছর থেকে বসার চেয়ারের এমন দৈন্যদশা থাকলেও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সিলেট-চট্রগ্রাম রুটে উদয়ন ও পাহাড়িকা নামে দুইটি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। উদয়ন ও পাহাড়িকার যাত্রা শুরু হয় ১৪টি কোচ নিয়ে। বিগত বছরগুলোতে কমানোর পর থাকে নয়টি কোচ। এছাড়া নড়বড়ে কোচ দিয়ে ট্রেনগুলো চলাচল করা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অবশেষে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিদের ডিও লেটারের প্রেক্ষিতে এই ট্রেনগুলোতে কোচ সংখ্যা ১৬টি করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, ২০১৪ সালে সিলেট-ঢাকা রুটে ১৪টি কোচ নিয়ে যাত্রা শুরু করে কালনী এক্সপ্রেস। এরপর কোচ কমিয়ে আনা হয় চারটিতে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত চারটি কোচ নিয়ে যাত্রী পরিবহণ করে কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনটি। এরপর ২০১৮ সালের শুরুর দিক থেকে আটটি কোচ নিয়ে চলাচল করে। পরে আরও একটি কোচ কমিয়ে আনা হয়। জয়ন্তিকা ও উদয়ন এক্সপ্রেস মাঝখানে কমে ১২টি কোচ নিয়ে চলাচল করে। পরে অবশ্য আরও চারটি কোচ যুক্ত করা হয়। পারাবত এক্সপ্রেসে ১৫টি থেকে ৩টি কমিয়ে ১২টি করা হলেও এখন ১৬টি কোচ নিয়ে চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৯
এনইউ/এসএ
আরও পড়ুন>>>তূর্ণার লোকোমোটিভ মাস্টার দায়ী: রেলমন্ত্রী