ওসি মোয়াজ্জেমকে আদালত কি শাস্তি দেয় সেদিকে তাকিয়ে নুসরাতের স্বজন, সহপাঠী ফেনীর সাধারণ মানুষ থেকে গণমাধ্যম কর্মীরাও। কারণ ঘটনার শুরুর দিকে ওসি মোয়াজ্জেম চেয়েছিলেন এ হত্যাকাণ্ডটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) সেই অপেক্ষার শেষ হতে চলেছে। নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দি ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার রায় ঘোষণা হবে বৃহস্পতিবার। গত ২০ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলার রায়ের জন্য এদিন ধার্য করেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। ওসি মোয়াজ্জেমের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় সে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন নুসরাতের স্বজন, সহপাঠী ফেনীর সাধারণ মানুষ থেকে গণমাধ্যম কর্মীরাও।
নুসরাত জাহান রাফির মা শিরিন আখতার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি আদালতে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছি, আমি বলেছি ওসি মামলাটাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। একজন দায়িত্ব শীল অফিসার হিসেবে এটা তিনি ঠিক করেননি। ওসি মোয়াজ্জেমের সাজা হলে নুসরাতের আত্মা শান্তি পাবে।
নুসরাতের বান্ধবী নিশাত বলেন, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে যৌন হয়রানির পর নুসরাত যেমন অপমান বোধ করেছিল ওসি মোয়াজ্জেমের ভিডিও ধারণের সময়ও নুসরাত তেমন অপমান বোধ করছিল। আমরা ওসির এমন অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
ওসি মোয়াজ্জেম যখন এ হত্যাকাণ্ডটিকে আত্মহত্যা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন ঠিক সে সময়ে ফেনীর সাংবাদিকরা ছিল ঠিক বিপরীত অবস্থানে। সাংবাদিকরা বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন এটি আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত হত্যা। পরবর্তীতে এ কারণে পুলিশের রোশানলেও পড়তে হয় সাংবাদিকদের। ফেনীর বেশ কয়েকজন পেশাদার সাংবাদিকের নামেও দেওয়া ষড়যন্ত্রমূলক মামলা।
এ প্রসঙ্গে ফেনী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক নুরুল করিম মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওসি মোয়াজ্জেমের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিৎ। কারণ তিনি আইনের পরিপন্থিভাবে থানায় ডেকে নিয়ে নুসরাতের যে জবানবন্দি তিনি রেকর্ড করেছেন। তা তিনি রেকর্ডও করতে পারেন না এবং প্রচারও করতে পারেন না। তিনি এটা করে আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে করেছে। তিনি নুসরাতকে খারাপ মেয়ে হিসেবে ট্রিট করতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য প্রচার করতে গিয়ে পুলিশের রোশানলের শিকার হতে হয়েছে সাংবাদিকদের। ফেনীর কয়েকজন সাংবাদিককে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে তিনি। আমরা এমন কাজের প্রতিবাদও করেছি।
এদিকে, আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এ পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে নিহতের পরিবার ও স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। পরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তদন্ত প্রতিবেদনেও সেটি উঠে আসে। নুসরাতকে কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় চলতি বছরের ২৪ অক্টোবর ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এখন আইসিটি আইনের মামলাটিতে এ পুলিশ কর্মকর্তার কি হবে? এ নিয়ে জনমনে প্রশ্নে উঠেছে।
এ হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত শেষে পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত দল সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেমসহ চার পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। পরে গত ১৫ এপ্রিল এ ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। এ মামলার পর ওসি মোয়াজ্জেম ২০ দিন পালিয়ে থাকার পর গত ১৬ জুন হাইকোর্ট এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ।
নুসরাতকে হত্যার রায়ের দিন ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেছিলেন, নুসরাত হত্যা মামলায় সংশ্লিষ্ট থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে অভিযুক্ত করা হলে মামলার রায়টি পূর্ণতা পেতো। মোয়াজ্জেমের সাজা যদি কনফার্ম করা হয়, ন্যায়বিচারের মাধ্যমে যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে নুসরাত জাহান রাফির আত্মাপরিপূর্ণভাবে শান্তি পাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নুসরাতকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে তার মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি মোয়াজ্জেম। পরে সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি ছড়িয়েও দেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ১৫ এপ্রিল ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন।
এরপর বিচারক মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। গত ২৭ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা মামলার ১২৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালে। এরপর বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরে গত ১৬ জুন দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। মামলাটিতে এ পর্যন্ত বাদী, নুসরাতের মা ও ভাইসহ আটজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষী বাকি রয়েছে।
নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত শেষে পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত দল ফেনীর পুলিশ সুপার ও সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসহ চার পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলা তুলে না নেওয়ায় গত ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গত ৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে প্রধান আসামি করে আট জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪/৫ জনকে আসামি করা হয় সেখানে। কিন্তু অনেকেই এ ঘটনায় সোনাগাজীর পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতি এবং আসামি ধরতে গড়িমসির অভিযোগ করেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
ঘটনার দিন নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় পরীক্ষাকেন্দ্রে পুলিশ ছিল। তারপরও এ রকম ঘটনা কীভাবে ঘটল। দোষীরা কীভাবে পালিয়ে গেলো। ওই ঘটনার তিনদিন পরও আসামি গ্রেফতারে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার ভাইয়ের দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলাটি রূপান্তরিত হয় হত্যা মামলায়। তখন অভিযোগ ওঠে, ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের মৃত্যুর বিষয়টি ‘আত্মহত্যা’ বলার চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৪০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
এসএইচডি/আরআইএস/