ঢাকা, বুধবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভিয়েতনামকে পাশে পাওয়ার আশা বাংলাদেশের

শাওন সোলায়মান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভিয়েতনামকে পাশে পাওয়ার আশা বাংলাদেশের সামিনা ন্যাজ। ছবি: বাংলানিউজ

হ্যানয়, ভিয়েতনাম থেকে: ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নেন সামিনা নাজ। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে আসা এই কূটনীতিক দুই দেশের মধ্যকার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখছেন খুব কাছ থেকে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যার এই সময়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভিয়েতনাম। দুই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সামিনা নাজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের প্রতিবেদক শাওন সোলায়মান। 

বাংলানিউজ: ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সংক্ষেপে আপনার অভিজ্ঞতা শুনতে চাচ্ছি।  
সামিনা ন্যাজ: ২০১৭ সালের আগস্টে আমি এখানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নেই।

গত দুই বছর ধরে এখানকার বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি এখানকার রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশ দেখেন এখানকার একজন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বাণিজ্য সংগঠনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডেস্ক ও সংগঠন, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি করার। তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে আমাদের উন্নয়নের চিত্র তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। তাদের বোঝাতে চেয়েছি যে, আমরা দুই পক্ষই একে অপরের সাহায্যে কাজ করতে পারি। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরেক ধাপ উপরে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।  

বাংলানিউজ: ভিয়েতনামের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রেক্ষাপট কেমন?
সামিনা ন্যাজ: ২০২০ সালে পররাষ্ট্র বিষয়ে দারুণ কিছু করার সুযোগ রয়েছে ভিয়েতনামের। সে বছর আশিয়ান চেয়ার হচ্ছে তারা। অন্যদিকে জাতিসংঘের অস্থায়ী নিরাপত্তা পরিষদে ২০২০-২১ সালের জন্য সদস্য নির্বাচিত হয়েছে দেশটি। কাজেই ২০২০ সাল ভিয়েতনাম ও দেশটির পররাষ্ট্র বিষয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।   

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আশিয়ানভুক্ত দেশ হিসেবে ভিয়েতনাম গুরুত্বপূর্ণ। আবার সার্কভুক্ত ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে আমরাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশই নিজেদের জায়গায় সক্ষমতায় প্রায় সমান। তাই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে সাহায্য ও যোগাযোগ বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। দুই পক্ষরই একে অপরকে আরও ভালো করে জেনে, এগিয়ে এসে বন্ধন গড়ে তোলা দরকার।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
সামিনা ন্যাজ: প্রথমে আমাদের ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে যে, আমরা একে অপরকে কোন দৃষ্টিতে দেখি। আশির দশকের শেষ দিকে অথবা নব্বইয়ের শুরুর দিকে ভিয়েতনাম নিয়ে যখন আমরা আমাদের কৌশল নির্ধারণ করি, তখন তাদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশ ধরে সি-ক্যাটাগরিতে রেখে আমাদের কৌশলগুলো নির্ধারণ করা হয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা দ্বিপাক্ষিক সবকিছুতেই এভাবে কৌশল নির্ধারণ করা হয়। তবে এখন আমরা সেই অবস্থানকে পুনর্বিবেচনা করছি। কারণ ভিয়েতনাম এখন আর আগের অবস্থানে নেই। অন্যদিকে আমাদেরও উন্নতি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১০ বছরে আমাদের অর্থনীতিতে দারুণ সাফল্য এসেছে। সব মিলিয়ে এখন আমরা ভিয়েতনামকে সেভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা করছি যেভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়ানো যায়। বাণিজ্যসহ দুই পক্ষের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, যেমন কূটনৈতিক অর্থনৈতিক, সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দৃঢ় করতে কাজ করে যাচ্ছি।  

উদাহরণ দিয়ে বললে, ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ সফরের জন্য অনেক আগে থেকেই আমন্ত্রণ জানানো ছিল। কিন্তু সেটি হচ্ছিল না। ২০১৫ সালে আমাদের রাষ্ট্রপতি ভিয়েতনাম সফর করেন এবং এখানকার রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। আমার মনে হয়, ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশে নিতে পারলে দুই পক্ষের মধ্যকার সম্পর্কে একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’ আসবে। সবপর্যায়ে কথা বলে সেই সফর সফলভাবে করতে পেরেছি।  

বাংলানিউজ: বাংলাদেশের প্রতি ভিয়েতনামের প্রতিক্রিয়া কেমন?
সামিনা ন্যাজ: দুই দেশই একে অপরের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। আমাদের আর ওদের স্বাধীনতার ইতিহাস দেখলে অনেক মিল পাওয়া যাবে। আমাদের যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আছেন, তেমনি তাদের আছেন হো চি মিন বা আংকেল হো। তবুও দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগটা সেভাবে ছিল না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে যে একটি আবেগীয় ব্যাপার আছে, সেটি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় আমরাই প্রথম ও পুরো এশিয়ায় দ্বিতীয়, যারা ভিয়েতনামকে আগে স্বীকৃতি দিয়েছে।  

আমি এখানে আসার আগে প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) আমাকে দারুণ কিছু পরামর্শ ও তথ্য দিয়েছেন, যা আমার কাজে খুব সাহায্য করেছে। যেমন- তার ভাই শহীদ শেখ কামাল ভিয়েতনামের স্বাধীনতার পক্ষে ১৯৭২-এ শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে এখানে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও শিক্ষার্থী অবস্থায় ভিয়েতনামের স্বাধীনতার স্বপক্ষে আন্দোলন করেছিলেন। সেসব দলিল ও ছবি ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেও সংরক্ষিত আছে। ভিয়েতনামের সর্বোচ্চ মহলে এসব বিষয় আমি তুলে ধরলাম। তারা তখন ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের ‘ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট’ আরও বেশি উপলব্ধি করলো। আর তারপর থেকেই ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় ও সাবলীল হয়।  

বাংলানিউজ: রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জানতে চাই। ভিয়েতনামকে কতটুকু পাশে পাচ্ছি আমরা? 
সামিনা ন্যাজ: দেখেন, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম দুটোই কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম-প্রধান। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও এখানে বৌদ্ধ ধর্মের বেশ প্রভাব। ভিয়েতনামে কিছু দূর পরপর দেখবেন মন্দির বা প্যাগোডা আছে। শুধু বৌদ্ধ ধর্মের না, ওদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নামেও ওরা মন্দির বানায়। কাজেই রোহিঙ্গা ইস্যু বা যেকোনো ইস্যুতেই ভিয়েতনাম মিয়ানমারকে আগে সমর্থন দেবে। তবে তাই বলে আমরা আমাদের কূটনৈতিক চেষ্টা থামিয়ে রাখিনি।

সবশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ২০১৭, ’১৮ ও ’১৯-এর তিনটি ভোটাভুটিতে ভিয়েতনাম জাতিসংঘ বিলের বিপক্ষে ‘না’ ভোট দিয়েছে। এমন বাস্তবতায় আমরা ভিয়েতনামকে আহবান জানাচ্ছি অন্তত তারা যেন ভোট দেওয়া থেকে ‘বিরত’ থাকে। এটুকু হলেও আমাদের জন্য বেশ সফল একটি ব্যাপার হবে। তবে আবারও বলছি, বিষয়টিকে মোটা দাগে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। ওদের ধর্ম, আঞ্চলিক সম্পর্ক, কমিউনিজম অনেক কিছু জড়িত। তবুও ভিয়েতনামকে পাশে পেতে আমরা আশাবাদী।  


.

বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
এসএইচএস/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।