সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সিরাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ শহরকে হানাদারমুক্ত করার জন্য সদর উপজেলার খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের শৈলাবাড়ী পাকবাহিনীর ক্যাম্পে হামলা করে মুক্তিযোদ্ধারা। তবে সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে টিকে থাকতে না পেরে পিঁছু হটেন তারা।
তিনদিক থেকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধার। পূর্বদিক থেকে নেতৃত্ব দেন মোজাম্মেল হক ও ইসহাক আলী। সোহরাব আলী সরকার ও লুৎফর রহমান দুদুর নেতৃত্বে পশ্চিম দিকে এবং আমির হোসেন ভুলু ও জহুরুল ইসলামের নেতৃত্বে উত্তর দিক থেকে আক্রমণ চালানো হয়। এছাড়াও দক্ষিণ দিক থেকে ইসমাইল হোসেন ও আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা। রাত তিনটা পর্যন্ত প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনে করে ঈশ্বরদীর দিকে পালিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে শহরের ওয়াপদা অফিসে পাকবাহিনীর প্রধান ক্যাম্পও দখলে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। ওইদিন কওমী জুটমিল (বর্তমানে জাতীয় জুটমিল), মহুকুমা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে উড়িয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এভাবে সম্পূর্ণরূপে হানাদারমুক্ত হয় সিরাজগঞ্জ। মুক্তি সিরাজগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইসমাইল হোসেনকে (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) এবং মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় মরহুম আমির হোসেন ভুলুকে।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ সরকার বলেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। বিভিন্ন স্থানে তারা ক্যাম্প স্থাপন করেই নিরীহ বাঙালির উপর জুলুম নির্যাতন চালাতে থাকে। ধর্ষণ-গণহত্যার পাশাপাশি চলতে থাকে অগ্নিসংযোগ। সমগ্র শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর-আলশামস বাহিনী। ১৭ জুন উত্তরাঞ্চলের বেসরকারি সাব-সেক্টর পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের নেতৃত্বে কামারখন্দের ভদ্রঘাটে প্রথম যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এরপর বাঘাবাড়ি, বরইতলী, বাগবাটি, ঘাটিনা, ছোনগাছা, ভাটপিয়ারী, ব্রহ্মগাছা, ঝাঐল ও নওগাঁসহ বিভিন্ন স্থানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এসব যুদ্ধে অর্ধ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হওয়ার বিপরীতে সহস্রাধিক পাকবাহিনী ও তাদের দোসর নিহত হয়।
পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের চিফ ইন কমান্ড (সিএনসি) গাজী সোহরাব আলী সরকার বলেন, প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে সেদিন সিরাজগঞ্জে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের এক কাতারে সমবেত ও সংগঠিত করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম মরহুম আমির হোসেন ভুলু, তৎকালীন মহুকুমা প্রশাসক শহীদ শামসুদ্দিন, পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের পরিচালক মরহুম আব্দুল লতিফ মির্জা (সাবেক এমপি), মরহুম লুৎফর রহমান অরুন, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, জহুরুল ইসলাম, আলাউদ্দিন শেখ, ইসহাক আলী, মরহুম আবু মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, আব্দুল হাই তালুকদার, বিমল কুমার দাস, শফিকুল ইসলাম শফি, ফিরোজ ভুইয়া, মরহুম টিএম শামীম পান্না, মেজর মোজাফ্ফর, মরহুম এম এ রউফ পাতা প্রমুখ।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিরাজগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার গাজী শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, ৯ ডিসেম্বর থেকে সিরাজগঞ্জকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মাঝখানে ১০ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতীর পর টানা তিনদিন (১১-১৩) রক্তক্ষয়ী লড়াই চলতে থাকে। এ যুদ্ধে শহীদ হন ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাবীব কালু ও সুলতান মাহমুদ সহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা।
সিরাজগঞ্জ মুক্ত দিবস উপলক্ষে শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও জেলা আওয়ামীলীগ পৃথক কর্মসূচি পালন করবে। মুক্ত দিবসের পাশাপাশি একই সঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসও পালন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯
এসএইচ