কেউবা বড়শির ছিপ নিয়ে মাছ ধরতেই পার করবে সময়। কাকের চোখের মত স্বচ্ছ পানিতে প্রতিবম্বিত হবে তাদের অবয়ব।
কাটাখালি নদীকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে এমন হাজারো স্বপ্ন বুনে আসছিল সিরাজগঞ্জবাসী। কাটাখালির সৌন্দর্যই সিরাজগঞ্জ শহরের সৌন্দর্য ফুটে উঠবে। স্বপ্নের শহরে রূপ নেবে যমুনা পাড়ের এ শহরটি, এমনটি আশা সব শ্রেণি-পেশার মানুষেরই।
কিন্তু শহরবাসীর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও হোঁচট খেতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। অবশেষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘৬৪ জেলায় ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন’ প্রকল্পের আওতায় কাটাখালি খনন প্রক্রিয়া শহরবাসীকে অনেকটাই স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
জানা যায়, সিরাজগঞ্জ শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা কাটাখালি নদীটি বৃটিশ আমল থেকে প্রবাহমান ছিল। তবে সিএস জরিপে ভিন্ন দুটি মৌজায় বড়াল ও ধানবান্ধি নদী নামে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১৮৯৩ সালে এই বড়াল নদীর ওপর নির্মিত হয় খুঁটিবিহীন দৃষ্টিনন্দন লোহার সেতু। বাংলার তৎকালীন ছোট লাট স্যার আলফ্রেড ইলিয়ট সাহেবের নামানুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয় ইলিয়ট ব্রিজ (শহরবাসীর কাছে বড়পুল নামে পরিচিত)। যা আজও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। সংস্কারের অভাবে একসময় মৃতপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল এ নদীটি। পরবর্তীতে তৎকালীন নীলকরের এক জমিদার যমুনা নদী থেকে সরাসরি নৌকায় শহরে মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য নদীটি পুনঃখনন করে যমুনার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। তখন থেকেই এটি কাটাখালি নামে পরিচিত হয়।
ওই সময় শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে পয়ঃনিষ্কাশনের সব পানি এ নদী দিয়ে নেমে যমুনা ও ফুলজোড় নদীতে মিশে যেতো। এরপর আবারও দখল, দূষণ সন্ত্রাসের কবলে পড়ে যৌবন হারিয়ে ফেলে কাটাখালি। ২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদীটির অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে ধাবিত হয়। নদীর যে অংশটুকোর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল সেটাও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। কাটাখালি অবৈধ দখলমুক্ত ও পুনঃখননের জন্য দু’দফায় উদ্যাগ নিয়েও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে পূর্ণতা পায়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ‘৬৪ জেলায় ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন’ প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য নদীর পাশাপাশি কাটাখালিও খনন করা হচ্ছে। তিনটি প্যাকেজের মাধ্যমে ২২ কিলোমিটার এ প্রকল্পটি গত বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও কাটাখালিকে দখলমুক্ত করার পর পুনঃখনন করা হচ্ছে। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৪৪ শতাংশ কাজ এগিয়েছে।
শিক্ষক লোকমান হোসেন, সাংস্কৃতিক কর্মী সূর্য্যবারী, ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলামসহ অনেকেই বাংলানিউজকে বলেন, সিরাজগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি কাটাখালি পুনঃখনন করে এর সৌন্দর্য বর্ধন করা। এর আগে দফায় দফায় কাটাখালি খনন ও দখলমুক্ত করার চেষ্টা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সফলতার মুখ দেখেনি। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এ প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর তাদের দুঃসাহসিক পদক্ষেপে সিরাজগঞ্জের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষই সন্তষ্ট। দ্রুতগতিতে তারা খনন করছে। এ নদীটি খননের পর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ পাউবোকে দিলে শহরবাসীর স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা আন্দোলনের নেতা নব কুমার কর্মকার বাংলানিউজকে জানান, শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়া কাটাখালিকে অবৈধ দখলমুক্ত ও সংস্কার করার জন্য প্রায় ১৪/১৫ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছিল সিরাজগঞ্জবাসী। এর আগে, ২০০২ সালে অবৈধদখল উচ্ছেদ করে পুনঃখনন করা হয়। কিন্তু সেই প্রকল্প বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেনি। আবারও দূষণ-দখলের কবলে পড়ে কাটাখালি। বর্তমান পৌর কর্তৃপক্ষ ফের কাটাখালি পুনঃখনন ও সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেটাও সফলতার মুখ দেখেনি। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৯ সালে প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার পর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে শহরবাসী। ইতোমধ্যে কাজের অগ্রগতি মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। তবে আমরা এর শেষটাও ভাল দেখতে চাই।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী একেএম রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৬৮ সালে ব্রহ্মপূত্র ডানতীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় যমুনার সঙ্গে কাটখালের সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে মরা নদীতে পরিণত হয় এটি। পাউবোর চলমান প্রকল্পে ২২ কিলোমিটার কাটাখালি নদী পুনঃখনের পাশাপাশি বা ঐতারা এলাকায় রেগুলেটর বসিয়ে যমুনার সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। অপরদিকে, উত্তরে ইছামতি হয়ে ফুলজোড় নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২০
এনটি