ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নুসরাত হত্যাকাণ্ড, এঁকে দিয়েছে প্রতিবাদের ভিন্ন চিত্র

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০২০
নুসরাত হত্যাকাণ্ড, এঁকে দিয়েছে প্রতিবাদের ভিন্ন চিত্র নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে ফেনীর রাজপথে মশাল মিছিল।

ফেনী: মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি, শুধু একটি নাম নয়, একটি আখ্যান। ফেনী জেলার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত যে চরম নৃশংসতা ও বর্বরতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তা শুধু ফেনী নয়, বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আলোচিত হয়েছে সারাবিশ্বে। আর সে কারণেই নারী আন্দোলন ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে থাকবেন মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত। এমনটাই মনে করছেন নুরাতের মা শিরিনা আখতার।

২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষার আরবী প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে গেলে হল থেকে ডেকে নিয়ে পাশের ভবনের তেতলার ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় তাকে কেরোসিন ঢেলে হত্যার চেষ্টা চালান আসামিরা। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়।

চারদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় মৃত্যুবরণ করেন নুসরাত। ১০ এপ্রিল বিকালে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে সোনাগাজী মো. ছাবের সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নামাজে জানাজা শেষে সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেই কবরেই চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন রাফি।

বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) এ আলোচিত হত্যার এক বছর শেষ হতে চলেছে।

এ এক বছরে হয়েছে অনেক কিছু। আসামিরা ধরা পড়েছেন, বিচারিক আদালতে তাদের ফাঁসির রায়ও হয়েছে। এখন সবাই তাকিয়ে আছে উচ্চ আদালতের দিকে। উচ্চ আদালতে আসামিদের ফাঁসি বহাল থাকবে? না আইনের ফাঁক গলিয়ে কেউ পার পেয়ে যাবেন, সেই শঙ্কায় দিন পার করছেন নুসরাতের পরিবার, স্বজন ও নুসরাত হত্যার ন্যায়বিচারের জন্য রাস্তায় সক্রিয় থাকা আন্দোলনকারীরা।

নুসরাতের হত্যার এক বছর ও হত্যার প্রতিবাদের বিষয়ে বাংলানিউজের কাছে প্রতিক্রিয়া জানায় ফেনীর কয়েকজন নারী সংগঠক ও উদ্যোক্তা।

ফেনীর নারী লেখক সাহিদা সাম্য লীনা বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক নারী নির্যাতিত হয়েছে। সেই ৯৬ এর ইয়াসমিন থেকে শুরু করে  এরপর বুশরা, সনি , তনু, রুপাসহ হাজার নারী। সব হত্যাই আলোড়ন তুলেছিল এই দেশে। অনেক হত্যার বিচার তো দূরে থাক, আসামিরা খালাস ও কোনোটার আসামি ধরাও পড়েনি আজও। তবে ফেনীর নুসরাতের হত্যাকাণ্ডটি ভিন্ন একটি প্রতিবাদের চিত্র এঁকে দিয়েছে। এর কারণে দ্রুত সময়ে হয়েছে বিচার। নুসরাতের জানাজায় লাখো জনতা। ফেনী সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাদিয়া সুলতানা রাত্রি বলেন, ‘নুসরাত একটি প্রতিবাদী চেতনার প্রতীক। সমাজের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, নারীর প্রতি অসম্মান সবকিছুর প্রতিবাদ করে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়ে গেছে নুসরাত। একজন শিক্ষকের যৌন সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করে জীবন দিতে হলো নুসরাতকে। এখনো অনেক নুসরাত অনেক তনুরা জীবন কাটায় কিছু মানুষরুপি পশুর নির্যাতন সহ্য করে। একদিন হয়তাও আমরা আলোর মশাল নিয়ে পথে পথে বেরিয়ে যাবো কারণ সেই মশালে আগুন জ্বালিয়ে গেছে নুসরাত।

মেহজাবীন রাখি নামের আরেক নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘নুসরাত প্রতিবাদী নারী হিসেবে খুব জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে ফেনী নয় শুধু সারা বাংলাদেশের ইতিহাসে। নিজের সঙ্গে কোনো অন্যায় মেনে নেয়নি সে, ক্ষমতাসীনকে ভয় পেয়ে দমে যায়নি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে। এমনকি তাকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার পরও তার প্রতিবাদের ভাষা বদলানো যায়নি। '

প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মাহবুবা তাবাস্সুম ইমা নামের আরেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠক, তিনি বলেন নুসরাত হত্যা নারীদের বিবেককে নাড়া দিয়েছিলো। নুসরাত হত্যার  আগে আমার মা নিজে বলতো কেউ কিছু বললে চুপ করে বাসায় চলে আসা উচিত কিন্তু না এখন আমার মা নিজেই বলে প্রতিবাদ করা উচিত এক নুসরাতের মতো আর কোনো নুসরাতের মায়ের বুক খালি হোক তা আমি চাই না।

যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোটের আহ্বায়ক শিবলী হাসান বলেন, ‘আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বিচার আদায়ের ক্ষেত্রে নুসরাত হত্যা মামলার রায় আমাদের এক নতুন দিনের পথ দেখিয়েছে। জনতার আন্দোলন কিভাবে রাষ্ট্র ও সরকারকে সঠিক পথ দেখাতে পারে নুসরাত হত্যা মামলা তার বড় উদাহরণ। জনতার দাবির মুখে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের রায় হলেও আমরা চূড়ান্ত রায় ও তার কার্যকরের প্রত্যাশায় আছি। আমাদের আশা থাকবে, নুসরাত হত্যা মামলার বিচার যেনো বাংলাদেশের আইন, শাসন ও বিচারবিভাগের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকে। '

সামাজিক সচেতনতামূলক সংগঠন ইতিবাচকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সমন্বয়ক নাসিম আনোয়ার জাকি বলেন, ‘নুসরাত হত্যা আমাদের ফেনীবাসিকেতো বটেই পুরো বাংলাদেশের মানুষকে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবিয়েছিল। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেলো। এত দ্রুত বোধহয় আর কোনো নারী নির্যাতন মামলার রায় হয়নি। তার পেছনে অবশ্যই একটি বড় ভূমিকা রেখেছে যুব সমাজের প্রতিবাদ। পুরো বাংলাদেশের যুব সমাজ তখন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল। '

নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার রাফির শূন্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছি। শুনেছি উচ্চ আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল করেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে আসামিদের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি। হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় আন্দোলন করছে ছাত্রীরা। আবেগে আপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‌'আজ একটি বছর আমি আমার মেয়ের কণ্ঠে মা ডাকটি শুনতে পাই না। রাতে ঘুম হয় না। আমার মেয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আমাকে অনেক কথা বলেছে। তখন আমার মেয়ে নুসরাতকে আমি বলেছিলাম মামলা তোলার জন্য সাদা কাগজে সই দিতে। তাহলে তোমার এই অবস্থা হতো না। '

তিনি আরো বলেন, ‘আমার মেয়ে মৃত্যুকে ভয় না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিল। '

মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, ‌'আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছি। উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশী। আমাদের পরিবারের জন্য খুনিরা ও তাদের স্বজনদের মারাত্মক হুমকি হচ্ছে তাদের ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিষোদগার করে যা ইচ্ছা তাই লিখে যাচ্ছে। আমাদের পরিবারের জন্য খুনি ও তাদের স্বজনদের ব্যবহৃত ফেসবুকই হচ্ছে চরম আতঙ্ক। '

বাদীপক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু বলেন, ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার সব ধরনের কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার সব ধরনের কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার সব নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিল।

পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকারভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ আইনজীবী আশা করেন, করোনা ভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতি কেটে গেলে অগ্রাধিকারভিত্তিতে মামলাটির শুনানি হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০২০
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।