চাষাবাদ এবং ক্ষেত-খামার করে জীবন চলে এখানকার ৮০টি পরিবারের ছয় শতাধিক মানুষের। আর বিনিময়ে গ্রামবাসীকে পাহারা দিতে হয় বন।
বলছিলাম কক্সবাজারের রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের অতি দুর্গম ব্যাঙডেবা গ্রামের কথা। যার অবস্থান উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে।
পাড়ার হেডম্যান আলী আহম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৪৭ সালের দিকে এই গ্রামে প্রথম বসতি শুরু হয়। গ্রামটির আয়তন প্রায় ৮০ একর। প্রথম দিকে ২৫-৩০টি পরিবার ছিল। বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ৮০টি পরিবার এখানে বসবাস করছে। জনসংখ্যা হবে প্রায় ছয়শ।
তিনি আরও জানান, এ গ্রামে কারও নিজস্ব এক ইঞ্চি জমিও নেই। বন বিভাগের জমিতেই সবার বসবাস। আর গ্রামের পতিত জমি চাষাবাদ করে চলে গ্রামবাসীর জীবিকা নির্বাহ। বিনিময়ে গ্রামবাসী পালা করে বন পাহারা দেন। এভাবে দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বনকর্মীদের সঙ্গে মিলে মিশে প্রায় ৯শ একর সংরক্ষিত বন রক্ষায় কাজ করছেন দুর্গম পাহাড়ি জনপদ ব্যাঙডেবার মানুষ।
ব্যাঙডেবায় হাতির উৎপাত খুব বেশি। ধান ওঠার মৌসুমে উৎপাত আরও বেড়ে যায়। যে কারণে ফসলহানি ও বসতঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার সমস্যা রয়েছেই। এ পর্যন্ত গত ১০ বছরে অন্তত সাত জন বন্য হাতির আক্রমণে মারা গেছেন। এ অবস্থায় বন বিভাগের বিট কার্যালয় না থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তো। এমনকি এখানে বসতি করাও যেত না। গ্রামের ভেতরে বিট কার্যালয় থাকায় এ গ্রামে কোনোদিন একবারও ডাকাতি হয়নি। আবার গ্রামবাসী সহযোগিতা না করলে বিশাল এ বন রক্ষা করাও যেত না। তাই এখানে বনকর্মী ও গ্রামবাসী ভাই ভাই। একপক্ষ ছাড়া অন্যপক্ষ অচল। যোগ করেন আলী আহম্মদ।
স্থানীয় ইউপি সদস্য জসিমুল করিম বাংলানিউজকে জানান, আশি একরের মধ্যে প্রায় ষাট একরই চাষযোগ্য জমি। গ্রামবাসীরাই এখানে চাষাবাদ, ক্ষেতখামার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এতে গ্রামবাসীদের কারও কোনো ধরনের সমস্যা হয় না। যার যার মত বসতভিটায় ঘরবাড়ি নির্মাণ, ঘেরা-বেড়া এমনকি পাকা বাড়িও করা হয়েছে। বসতভিটায় নানা রকম ফলের গাছও লাগানো হয় তবে বনজ গাছ লাগালে তার মালিক হয়ে যায় বনবিভাগ।
বনবিভাগের জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জ কর্মকর্তা সোলতান মাহমুদ টিটু বাংলানিউজকে জানান, রামু উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বনাঞ্চলে এখন গাছ নেই বললেই চলে কিন্তু ব্যাঙডেবার সংরক্ষিত বনে এখনো আছে বিশাল বিশাল সেগুন গাছ (মাদারট্রি)। বনপ্রজাদের (গ্রামবাসী) সহযোগিতায় বনরক্ষা সম্ভব হয়েছে। বনবিভাগের সামান্য জনবল এবং গ্রামবাসীর সহযোগিতায় চলছে এ বিটের নয়শ একর সংরক্ষিত বন রক্ষার কাজ।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৩ সালের আগে ব্যাঙডেবায় বনবিভাগের কোনো কার্যালয় ছিল না। ১৯৮৩ সালে এখানে বিট কার্যালয় হয়। এর আগ পর্যন্ত গ্রামবাসীরাই এখানে বন পাহারা দিয়েছেন। ৮৩ সালের পর বনকর্মী এবং গ্রামবাসী মিলে মিশে বন রক্ষার কাজ করছেন। বর্তমানে ৪০টি পরিবারের আটজন পালা করে প্রতিদিন বন পাহারা দেন।
জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল শামসুদ্দিন আহমেদ প্রিন্স বাংলানিউজকে জানান, এলাকাটি খুবই দুর্গম হওয়ায় অনেকটা সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত এ গ্রামের মানুষ। তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করি তাদের সহযোগিতা করতে।
তিনি বলেন, ব্যাঙডেবা এলাকাটি এতটা দুর্গম এলাকা হলেও এখানে একটিবারের জন্যও চুরি ডাকাতি হয়নি। এর একটি কারণ, এই গ্রামের মানুষের একতা। মসজিদের মাইকে ডাক দিলেই মুহূর্তের মধ্যেই এক জায়গায় জড়ো হয়ে যায় পুরো গ্রামবাসী।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, ব্যাঙডেবার মত দেশের সব জায়গায় বন বিভাগ এবং এলাকাবাসীর মধ্যে এরকম সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলে বন রক্ষা আরও সহজ হত।
তিনি আরও বলেন, মূলত যাতায়াত সমস্যার কারণেই গ্রামটি এখনো অন্ধকারে পড়ে আছে। এ গ্রামের মানুষের অনেক সমস্যা। আর গ্রামটি যেহেতু সংরক্ষতি বনের মাঝখানে তাই বনবিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কীভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো যায় সে বিষয়টি আমি গুরুত্ব দিয়ে দেখবো। এছাড়াও গ্রামটিতে মোবাইল নেটওর্য়াক নেই, বিদ্যুৎও নেই। মোবাইল নেটওর্য়াক এবং বিদ্যুতের আওতায় আনা যায় কিনা সে বিষয়টিও দেখা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২০
এসবি/আরএ