করোনাকালের শুরু থেকে সিরাজগঞ্জ পুলিশের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে জানা যায়, মহামারিতে রূপ নেওয়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রথম থেকেই যুদ্ধে নেমেছে জেলা পুলিশ। দেশ-বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত, গণজমায়েত ও গণপরিবহণ চলাচলরোধ এবং মৃত ব্যক্তিদের জানাজা-দাফনসহ করোনাযুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে পুলিশবাহিনীর সদস্যরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৮ মে পৌর এলাকার মাছুমপুর মহল্লায় করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন। সদর থানা পুলিশ তার দাফনকাজ সম্পন্ন করে।
এর আগে ২১ মে সদর উপজেলার কুড়ালিয়া গ্রামে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যায় এক পোশাক শ্রমিক। এ সময় মরদেহসহ মৃত ব্যক্তির বাড়ি বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখে স্থানীয়রা। স্বজন ও এলাকাবাসীরা দাফনকাজে এগিয়ে না এলে সদর থানা পুলিশের দুই কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে যান। তারা বাঁশ দিয়ে খাট তৈরি, কবর খোঁড়া ও জানাজাসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে দাফন সম্পন্ন করেন।
২১ এপ্রিল রাতে ঢাকায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির মরদেহ সিরাজগঞ্জ মালশাপাড়া কবরস্থানে আনা হয়। মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা এগিয়ে না এলে পুলিশ দাফনকাজ সম্পন্ন করে। একইভাবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া সকল মৃতদেহের দাফন পুলিশকেই করতে হয়েছে।
৯৯৯ কিংবা থানার যেকোনো নম্বরে ফোন দিয়ে আক্রান্ত বা উপসর্গ থাকা ব্যক্তির খবর দিলেই সেখানে ছুটে যাচ্ছেন তারা। অসুস্থদের আইসোলেশন অথবা কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করে তাদের ও স্বজনদের বাড়ি লকডাউনের স্টিকার লাগিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। বাইরে থেকে আসা যেকোনো ব্যক্তির বাড়ি কোয়ারেন্টাইন স্টিকার নিয়ে ছুটে যাচ্ছে পুলিশ।
অপরদিকে দুস্থদের জন্য বরাদ্দ ত্রাণের চাল লুট ও জেলা প্রশাসনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাতেও সহায়তা করে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরাই।
শুক্রবার (০৫ জুন) দুপুরে জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে এখন পর্যন্ত জেলায় মোট ৯১ জন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৮ জনই পুলিশ সদস্য। একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ১১ জন।
আক্রান্ত পুলিশ সদস্যের মধ্যে সর্বোচ্চ বেলকুচি ও এনায়েতপুরে ৯ জন করে, কাজিপুরে ৩ জন, গোয়েন্দা শাখায় ৩ জন, সলঙ্গায় ২ জন এবং সদর ও শাহজাদপুর থানায় ১ জন করে আক্রান্ত হয়েছেন।
এর মধ্যে এনায়েতপুর ও সলঙ্গার ওসি কাজিপুরের পরিদর্শক (তদন্ত) ছাড়াও তিনজন উপ-পরিদর্শক, চারজন সহকারী উপ-পরিদর্শকসহ মোট ১০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন কাজিপুরের পরিদর্শকসহ তিনজন।
করোনা পরিস্থিস্থিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে সঙ্গীতশিল্পী ও অরুণিমা সঙ্গীতালয়ের পরিচালক সূর্য্য বারী বাংলানিউজকে বলেন, করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে মানুষকে যখন ঘরে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে-তখনই অলিগলি রাজপথ ঘুরে কাজ করছে পুলিশ। করোনা ঝুঁকি উপেক্ষা করেই তারা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলে পুলিশই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শামস-ই-এলাহী অনু বলেন, সিরাজগঞ্জের পুলিশ রাতদিন যেভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আক্রান্ত বা মৃত্যু ঝুঁকি থাকলেও সাধারণ মানুষকে রক্ষায় পুলিশ যুদ্ধ করছে। তারা যেভাবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে, তাতে সাধারণ মানুষ সাড়া দিলে মানবতার জয় হবেই।
পুলিশের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে সিরাজগঞ্জ জেলা স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, করোনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লড়ে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জের পুলিশ সদস্যরা। তাদের পরিশ্রমের কারণেই জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য জেলার চেয়ে অনেকটাই কম।
সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবু ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, পরিষ্কার থাকি, পরিষ্কার রাখি-এ স্লোগানকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে পুলিশবাহিনী। কাজ করতে যেয়ে জেলায় ২৮ জন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। তারপরও পুলিশ তার দায়িত্ব পালনে এক বিন্দুও পিছপা হয়নি।
সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, দেশ ও জনগণের জানমাল রক্ষার শপথ নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। এক্ষেত্রে কাজ যতটাই ঝুঁকিপূর্ণ হোক, পুলিশ তা করবে। করোনা মোকাবিলায় যেকোনো পরিস্থিতির জন্য পুলিশ সদস্যদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। আমাদের প্রতিটি থানাকে ৩ থেকে ৪টি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি গ্রুপ আক্রান্ত হলে দ্বিতীয় গ্রুপটি ওই থানায় দায়িত্ব পালন করবে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও চালানো হচ্ছে। ৯৯৯ ফোন পেয়ে আমরা শত শত ব্যক্তির বাড়িতে গোপনে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছি। যারা কখনো কারও কাছে হাত পেতে চাইতে পারবে না, এসব ব্যক্তিকে মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে-যেগুলো কোনোভাবেই আমরা প্রচার করিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০২০
আরএ