তালতলীর তাঁতিপাড়া এলাকা ঘুরে: বঙ্গোপসাগর, বিষখালী ও পায়রা নদ ঘেঁষা বরগুনার তালতলী উপজেলা। এ উপজেলায় প্রায় আড়াইশ বছর আগে রাখাইনরা এসে জঙ্গলাকীর্ণ অনাবাদি জমিকে আবাদযোগ্য এবং জনহীন ভূমিকে মানুষের বাসযোগ্য করে তুলেছিল।
গ্রামের মেঠোপথ। এক সময় ছিল অনুন্নত। এখন পিচ ঢালাই পথ। উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশও সমানতালে আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে উন্নত শিখরে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া সব জায়গায় লাগলেও এখনো সেই আদিকালের মতোই রয়ে গেছে এ অঞ্চলে রাখাইনরা।
জ্যৈষ্ঠের প্রখর রোদ আর বৃষ্টি মধ্যেই গেলাম সেই রাখাইনদের আবাস্থল তাঁতিপাড়ায়। যেখানে তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভরশীল অনেক আধিবাসী। আর এ পেশায় নারীরা শতভাগ সম্পৃক্ত। পরিবারের পুরুষরা মাঠে ঘাটে কাজ করে থাকেন।
তাঁতিপাড়া, যে গ্রামে শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে তাঁতের ঠক ঠক শব্দ শুনে বেড়ে ওঠে। লেখাপড়া করা তো দূরের কথা নামও লিখতে পারে না অনেকেই। দেশের ঐতিহ্য এই তাঁতশিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এছাড়া এ পেশায় জড়িত শ্রমিকরাও ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। দিনরাত পরিশ্রম করেও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য তারা পাচ্ছে না। এ অবস্থায় তাঁত পেশার ওপর নির্ভরশীল অনেক পরিবার এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। আর তাই ধীরে ধীরে এ পেশা থেকে সরে যাচ্ছে অনেকেই।
দেশের উপকূলীয় বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলা। এখানে অধিকাংশ মানুষই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। এখানকার মানুষ মাছের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও রাখাইন আধিবাসীদের হাতে বোনা তাঁতশিল্পের কারণে ঐতিহ্য বহন করে এ উপজেলা। তাছাড়া পায়রা তাপবিদুৎ কেন্দ্র, পর্যটন কেন্দ্র শুভসন্ধ্যা সি-বিচসহ সম্ভাবনাময় এলাকা। আদিকাল থেকেই রাখাইনরা শিক্ষার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যের বিষয়েও এখনো অসচেতন তারা।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় চাননুন (৫০) নামে এক জনের। ৮ বছর বয়স থেকেই বাপ-দাদার পেশায় কাজ শুরু করেন তিনি।
তিনি বলেন, দিনরাত পরিশ্রম করি। একটি চাঁদর তৈরি করতে তিন দিন সময় লাগে। তাতে খরচ হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। যা পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় ৪০০ টাকা। ওই চাঁদরই ঢাকার বড় বড় মার্কেটে বিক্রি হয় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায়। একে তো আধিবাসী হিসেবে আমরা বৈষম্যের শিকার তারপরে এতো শ্রম দিয়েও আমরা অর্থের দিক থেকেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।
একটা সময় ছিল এ অঞ্চলের প্রতি ঘরে তাঁতের কাপড় তৈরি হতো এখন বিলুপ্তির পথে কেন- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ঠিক মতো সুতো পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে পণ্য তৈরি করা হয়। কিন্তু ঠিক মতো বাজার না পাওয়ায় এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। তাছাড়া আধিবাসীদের জীবন-জীবিকার প্রধান পেশা তাঁতশিল্প ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে আসায় অনেক আধিবাসী ইতোমধ্যেই মিয়ানমারে চলে গেছেন।
এ বিষয়ে কথা হয় বরগুনা জেলা তাঁতি সমিতির সভাপতি মংচিন থায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথমত হচ্ছে সুতা তথা কাঁচামালের অভাব। তারপরে একটি তাঁতের চাদর তৈরি করতে তিন দিন সময় লাগে। এরপর ওই পণ্যটি ৪০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ এখন একদিনের শ্রমের মূল্য ৫০০ টাকা, সে ব্যক্তি তিন দিনে ১৫০০ টাকা আয় করে আর একজন তাঁত শ্রমিক তিন দিনে আয় করে মাত্র ৪০০ টাকা। এটি হলো প্রধান বাধা।
আধিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (কোডেক) প্রোগ্রাম সমন্বয়কারী মো. মনির উজ্জামান বলেন, বর্তমান আধুনিক যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে হস্তচালিত তাঁত শিল্প টিকতে না পেরে ধীরে ধীরে এ পেশা হারিয়ে যাচ্ছে। এ শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদের আধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে এ পেশায় টিকিয়ে রাখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে যদি সরকারের পক্ষ থেকে দৃষ্টি না দেওয়া হয় তাহলে খুব অল্প সময়ে তাঁতশিল্প একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দেশের ঐতিহ্যের কারণে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৯ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০২০
আরএ