বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) ১৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক এবং শিক্ষকের পক্ষ থেকে পাঠানো এক যুক্ত বিবৃতিতে এ কথা উল্লেখ করা হয়।
বিবৃতিতে সম্মতি প্রদানকারী ব্যক্তিরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুয়াজ্জেম হোসেন, ব্লাস্ট প্রধান হামিদা হোসেন, অধ্যাপক ড. শফিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক স্বপন আদনান, ড. তাজুল ইসলাম, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, দৃক গ্যালারির শহীদুল আলম, অধ্যাপক আজিজজুর রহমান, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার, অধ্যাপক এ. এন রাশেদা, অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, অধ্যাপক এম এম আকাশ, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌভীক রেজা।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২২টি পাটকল প্রাথমিকভাবে বন্ধ করে সেখানে সোনালি করমর্দন ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যেই সকল স্থায়ী শ্রমিককে চাকুরী থেকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন। অথচ আমরা সবাই জানি যে, অতীতে যে সব পাটকল ব্যক্তি খাতে হস্তান্তরিত হয়েছিল সেগুলি অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধ হয়ে গেছে, শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে, পাটের ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে এবং কৃষক পাটের বাজার হারিয়েছে। রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলের শ্রমিকরা যেসব সুবিধা পেয়ে থাকেন সরকারি মজুরী বোর্ড, কোয়ার্টার সুবিধা, পাটকল এলাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা, এই পদক্ষেপের ফলে সে সব অধিকারও শ্রমিকরা হারাবেন। ’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এসব নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে সরকার আজ এই নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই অতীতে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলে শ্রমিকরা আন্দোলন করে তা থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। তখন বর্তমান সরকার বিরোধী দলে রাজপথে ছিলেন এবং শ্রমিকদের পক্ষ নিয়েছিলেন। সরকার এবার চালাকি করে শ্রমিকদেরকে “সোনালি করমর্দনের” নামে ন্যুনতম ১৩ লাখ টাকা (দুই ভাগে নগদ ও সঞ্চয়পত্র হিসাবে) দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুপিসারে কাজটি সেরে ফেলতে চাইছেন।
তারা বলেন, সরকারের এই আত্মঘাতী প্রস্তাবের ফলে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শেষ চিহ্নটি বিলুপ্ত হবে এবং এর ফলে আমাদের আশঙ্কা যে, ব্যক্তিখাত পাটশিল্পকে হাতে নেয়ার পর এখানে নতুন অর্থ বিনিয়োগ না করে এই শিল্পের জমি ও অন্যান্য সম্পদের অন্য ধরনের ব্যবহার করে শিল্পকে লাটে উঠাবে এবং বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এই করোনাকালে পুনরায় বেকার হয়ে পড়বে। এভাবে সমগ্র পাট অর্থনীতির এক করুণ মৃত্যু ঘটবে এবং আমাদের বিশ্ববাজার প্র্রতিযোগী দেশগুলির হাতে চলে যাবে। পাট চাষীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা এও জানি যে পাটকলগুলি রক্ষার জন্য অতীতে আধুনিকায়নের বদলে বিএমআরই নামে যে দফায় দফায় নিষ্ফল অর্থ ব্যয় হয়েছে, উৎপাদন ছাড়াই বিজিএমসি’র মাথাভারী প্রশাসন বেতন নিয়ে এবং দিয়ে যে অপব্যয় করেছে, পাট ক্রয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, পাট পণ্যের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম রাখা হয়েছে, এগুলিই হচ্ছে বর্তমানে লোকসানের মূল কারণ। তাই আমরা দাবি জানাচ্ছি, পাট খাতের মৃত্যু না ঘটিয়ে, তাকে যথার্থ পুনরুজ্জীবনের জন্য বিজিএমসি’র দুর্নীতি দূর করে, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বদল করে, শ্রমিক নেতৃবৃন্দের দেয়া বিকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী পাটকলগুলি ব্যবস্থাপনা ও যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন করা হোক। ’
তারা আর বলেন, ‘উল্লেখ্য যে যন্ত্রপাতি বদলালে এবং ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি রোধ করতে পারলে ধাপে ধাপে সবগুলি পাট কারখানাকেই লাভজনক করা সম্ভব হবে। এর ফলে শ্রমিকদের রক্ত ও ঘামে গড়ে ওঠা পাট শিল্প যেমন রক্ষা পাবে, বাংলাদেশের “সোনালি আঁশের ব্রান্ড” এর সুরক্ষা হবে এবং চাষী ভাইয়েরা তাদের পাট বাজার অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন। এ ছাড়া পরবর্তীতে পাটের পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে, ব্যক্তিখাত ও সরকারি খাতের আরো নতুন নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে সমগ্র অর্থনীতিতে পাট খাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভূমিকাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। ’
বিবৃতির শেষাংশে বলা হয়, ‘সারা বিশ্বে আমাদের পাটের যে ঐতিহ্য আছে তাকে “ব্যক্তিগত খাত-সরকারি খাত” সহযোগিতার নামে এভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কাছে জলাঞ্জলী দেয়াটা আমরা সমর্থন করি না এবং দাবি জানাই যে, অবিলম্বে শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞদের বিকল্প প্রস্তাবটি নিয়ে সরকার উন্মুক্ত সংলাপে বসুক। ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করে একটি শিল্পকে শেষ করে দেয়ার চেয়ে মাত্র হাজার-বারোশ কোটি টাকা খরচ করে পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা নিশ্চয়ই দেশের জন্য, দশের জন্য অধিকতর কল্যাণকর হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০২০
আরকেআর/এমএইচএম