ঢাকা, সোমবার, ১৫ পৌষ ১৪৩১, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশে দর্শন-দৈন্য ও পারমাণবিক মানুষের জন্মস্বপ্ন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৭
বাংলাদেশে দর্শন-দৈন্য ও পারমাণবিক মানুষের জন্মস্বপ্ন বাংলাদেশের চিন্তকেরা

প্রাচীন পৃথিবীতে হঠাৎ কিছু হ্যাংলা বুদ্ধির চিন্তাচাষি এসে পড়ে চোখে বিস্ময় নিয়ে। যাদের প্রধান অবলম্বন ছিল সাদামাটা কিছু প্রশ্নের লাঙ্গল, আর কিছু না। হাবার মতন তারা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থেকেছে অপলক। তরলের সাথে, অনলের সাথে তাদের উদ্ভট আড্ডার ছিল না শেষ। মুগ্ধতা নিয়ে এসবের কাছে যেত এরা, নিরলস পড়ে যেত তাদের কত কিস্সা, শুনে যেত তাদের কত গভীর-গম্ভীর গান। পদতলে পড়ে থাকা নীরব মাটির শিহরণ রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়েছে তাদের তখন অবিরাম; পুলকিত হয়েছে তারা বাতাসে বয়ে আসা বার্তার চমকপ্রদ দুর্বোধ্যতায়।

এভাবে একদিন আনমনেই হয়তো তারা চেয়েছে ছাড়া-ছাড়া বাস্তবতার আবছা ছায়া ভাঙা শব্দরাজির প্রলাপ-আদলে বাঁধতে। আজ সেই প্রলাপকে আমরা দর্শন বলি আর সেই অকর্মণ্য হাবাদের বলি দার্শনিক, যারা ছিল এই বিশ্বের প্রাচীন মাটির প্রথম চিন্তাচাষি; যারা বুঝেছিল: একটু ঠাঁই আর খাদ্য ছাড়াও এই প্রকৃতির দেওয়ার আছে আরো অনেক কিছুই, শেখানোর আছে আরো বেশি।

সক্রেটিস-বৌদ্ধ-কনফুসিয়াস-পরবর্তী সময়ে এথেন্স ও আলেক্সান্দ্রিয়ায় আবির্ভাব ঘটলো পদার্থোত্তর সত্যসন্ধানী আরো তিনজন জ্ঞানপ্রেমমগ্ন বনেদি গৃহস্থের : প্লেটো, আরিস্টট্ল এবং প্লোটাইনাস, যারা তাদের পূর্বসূরি চিন্তাচাষিদের কর্ষণলব্ধ জ্ঞান আর শৃঙ্খলিত সূক্ষ্মবুদ্ধি মন্থন করে বুঝতে চেয়েছেন সৃষ্টিরহস্য, সমাধান করতে চেয়েছে জাগতিক আর পরাজাগতিক ধাঁধা। সভ্যতার মধ্য-বয়সের দিকে তারপরে ব্রিটিশ মাটিতে জন্ম নিলো আরেকটু পরিণত বিদ্যাচর্চীরা, যেমন অ্যানসেম, ‘ডক্টর মিরাবিলিস’ রজার বেকন (ফ্রান্সিস বেকনের আবির্ভাব ঘটে আরো পরে, আধুনিক দর্শনের প্রারম্ভে), ডান্স স্কটাসসহ আরো কয়েকজনা। ফরাসি মাটিতে প্রায় একই সময়ে জন্ম নিলেন প্লোটাইনাস শিষ্য পরফিরির দর্শন-অনুগামী পিটার অ্যাবেলার্ড।  

এদিকে ১৭ শতকের দিকে জার্মানিতে এলেন লাইব্নিজ তাঁর ‘মোনাড’ তত্ত্ব নিয়ে; তারও আগে ইতালিতে এলেন সিসেরো আর সেনেকার মতন মহা-দার্শনিকগণ। এই কিছুদিন আগেই পার্শ্ববর্তী স্বাধীন ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় প্রধান রাষ্ট্রপতি হয়ে এলেন বিশ্বখ্যাত দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। বাংলাদেশে কে এলেন? বাংলাদেশে কে আসবেন?

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আরো কিছু গুণী বুদ্ধিজীবীর বিচক্ষণ দূরদর্শিতার ফসল এই বাংলার দেশ, এই স্বাধীন বাংলাদেশ। তাঁরা প্রতিকূল বাস্তবতার মধ্যে থেকে অনেকটা সাহসী দার্শনিকের চোখ দিয়েই সময়ের আয়নায় দেখেছেন সামাজিক কাঠামোর রূপরেখা, দেখেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির নোংরা ও বিধ্বংসী সর্বগ্রাসী শক্তি, এবং তাদের আপাত সমাধান। বাংলাদেশের জন্মলগ্নপূর্বে তাঁদের সামাজিক ও জাতিগত সচেতনতা অনেকাংশে সমাজ-রাজনীতি দর্শন-মণ্ডিতই ছিল বটে। তবে, বাংলাদেশের ভিত্তিমাটিতে কখনই পড়েনি সত্যিকার অর্থে সকল মানবিক বিষয়ে পণ্ডিত আর নতুনকে জন্ম দেওয়ায় পারদর্শী কোন দার্শনিকের লাঙ্গলের আঁচড়। আমাদের মাতৃভূমি তাই আজ চিন্তাচাষিদের নয় বরং পাশ্চাত্য ধাঁচে আধুনিক হয়ে ওঠার খাতিরে মরিয়া চাষাদের আবাসস্থল। আমাদের বুদ্ধিজীবী ছিল, বোদ্ধা ছিল, ছিল না দার্শনিক, কখনও ছিল না, আজও নেই। গ্রহণযোগ্য অতিশায়ন, আর ‘কিছু হবে না’ জেনে, সম্মানার্থে আমরা কখনও কখনও আহ্লাদ করে কিছু লেখক-চিন্তাবিদকে দার্শনিক ডেকে থাকি এখন। তাতে ক্ষতি বিশেষ নেই। তাদের অবদানও কালের কোলে নতুন যুগকে জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তবু আক্ষরিক অর্থে কে ছিলেন আমাদের, যাকে পুরাদস্তুর দার্শনিক ডাকা যায়? কে আছেন? আরজ আলী হয়তো ৭১ সমকালীন হবেন, তবে স্বাধীনতা-ভাবনার সমসাময়িক নন। তাঁর প্রশ্নও ছিল অনেক, তবে প্লেটো বা রুশোর দর্শন-প্রবাহ যেমন তাদের রাষ্ট্রদর্শন, অর্থাৎ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গিয়ে পরিণতি পেয়েছে, সেভাবে মাতুব্বরের আলবৎ কোন মাতুব্বরি ছিল না। এর জন্য তাঁকে দোষও দেওয়া যায় না হয়তো।  

এদিকে তুলনামূলকভাবে ড. হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক তেজী শিক্ষক, কিছুটা ভালো মানের দর্শন আলোচক (ভালো কারণ বাংলাদেশে ওটুকুও কেউ করে না), অনুবাদক, আর ছিলেন বাংলা ভাষাতাত্ত্বিক, যার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষা বিষয়ে গবেষণাগ্রন্থের নাম Pronominalization in Bengali। আজাদ মূলত লিখেছেন ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে, আর লিখেছেন নারীবাদ নিয়ে। কিন্তু সচেতন পাঠক খুব সহজেই বুঝে যায় আজাদের কথাবিদ্যার পুরু পর্দার পিছনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুজন ভিনদেশি দার্শনিকের নিমন্ত্রিত আত্মা, একজনের নাম বারট্রান্ড রাসেল, আরেকজন সিমন দ্য বোভোয়া। তাঁর বহুল আলোচিত নারী বোভোয়ার জেন্ডার-স্ট্যাডিরই পুনরাবৃত্তি ও প্রলম্বিত বাংলা-আলোচনা। আহমদ ছফা আরেকটু সোজাভাবে বললেন “হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সহকারে সিমোন দ্যা বোভেয়ার বই বাংলা ভাষায় নিজে লেখেন। সমস্ত মাল-মসলা সিমোন দ্যা বোভেয়ারের। হুমায়ুন আজাদ এই বিদুষী দার্শনিক মহিলার পরিচ্ছন্ন রুচি এবং দার্শনিক নির্লিপ্ততা কোথায় পাবেন?...” 

এর জন্য আজাদকেও হয়তো দোষ দেওয়া যায় না। সময়টা ছিল অমনই, বাঁকা আবার সরল, স্থবির আবার চঞ্চল। নতুনত্বের খোলস মুড়ে কিছু বোকাসরল মানুষের আধুনিক হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, আর একে পুঁজি করে ছিল কিছু মানুষের উপরে ওঠার সুযোগ, ছিল এক সস্তা আত্মতুষ্টির সুযোগ। আরেকজন ছিলেন আহমদ শরীফ। তিনি দার্শনিক ছিলেন বটে তবে তাঁর পাণ্ডিত্য একপেশে, অনেকটা শুধু নাস্তিক্যবাদের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে; যে নাস্তিক্যবাদ কখনই ছুঁতে পারে নি হাইডেগার বা সার্ত্রে বা কামু বা নিৎশের যুগান্তকারী মৌলিক চিন্তার উচ্চতাকে।  

আজকে আমরা কিছুটা এগিয়েছি হয়তো। আজকে আমরা এডওয়ার্ড সাঈদ নিয়ে কথা বলি, গ্রামসি নিয়ে কথা বলি, কথা বলি ফুকো, দেরিদা, স্পিভাক, চমস্কি, বার্থ, হল, মিল, ভবাসহ আরো কত কাউকে নিয়ে। আজ আমরা ডিকনস্ট্রাকশন কপচাই, পোস্টকোলোনিয়ালিজম নিয়ে দেদারসে বমি উগরে দিই, বের হয়ে আসে বিদেশি শব্দ, ধর্ম-বিদ্বষ-ভয় মনে লালন করে ওরিয়েন্টালিজম বুঝে আর বুঝিয়ে পুলকিত হই। সমস্যা হলো, আমরা বেশিরভাগই সাহিত্য-সমাজতত্ত্ব আলোচক। বড়জোর তাত্ত্বিক। এর বেশি কিছু না। নতুনকে সৃষ্টি করার পুরাতন আত্মাটুকু বদলে দেবার লোক আমাদের বড়ই অভাব। দেশটার বয়সও খুব বেশি হয়নি এখনও বুঝি তাই। আমদানি করা পণ্য-চিন্তা-তত্ত্ব-ধর্ম আর মানচিত্রের মধ্যদেশে কিম্ভূত পোশাকি-ঢংয়ের ঔদ্ধত্য প্রদর্শনপূর্বক আমরা মহাসুখে এলান করি আমাদের গোটাটাই ‘উত্তরাধুনিক’। অথচ কী অদ্ভুত ব্যাপার, পশ্চিমা ঈশ্বর আর ইলেকট্রনিক্স বন্দনানির্ভর আমরা আজতক আধুনিক পর্যন্ত হতে পারলাম না! পারিনি কারণ আমরা এখনও পশ্চিমা বিশ্বের মুখাপেক্ষী। পারিনি কারণ আমাদের ‘আমাদেরই শুধু’ বলে কিছু নেই, নেই মৌলিকতা। নেই কেননা আমাদের ভূগর্ভে প্রাচীন দার্শনিকের লাশ আছে, কিন্তু মাটির উপরে নেই প্রচণ্ডভাবে জীবন্ত কোনো দার্শনিকের পদচারণা। আছে শুধু গুটিকয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ধুঁকতে থাকা মৃতপ্রায় কিছু প্রকাণ্ড দালান, যাদের আমরা ‘দর্শন বিভাগ’ নামে চিনে থাকি।

এখন দর্শন বিভাগের দোষটা কোথায়? মাতুব্বর আর আজাদের মতো বিভাগকেও ঠিক দোষ দেওয়া যায় না বোধহয়, কারণ দোকান-সভ্যতার মোজাইকে বসে খাঁটি আদর্শবাদ-চর্চা এক ক্ষমা-অযোগ্য আস্পর্ধা। তবুও বলতেই হয়, ৭১-ঘেঁষা সময়ে দার্শনিকতুল্য যে গুটিকয় মানুষ আমরা পেয়েছি, তাঁদের বেশিরভাগই হয় সাহিত্যিক, নয়তো বাংলা বিভাগের শিক্ষক অথবা কোনো প্রবীণ পাঁড়-রাজনীতিবিদ। তবে সাহিত্য-দর্শন বা শিক্ষা-দর্শন বা রাজনীতি-দর্শন আর দর্শন-দর্শন তো এক না। দর্শন-দর্শন হল বাস্তব-পরাবাস্তব-বাস্তবোত্তর জটিলতার গহীনে এক ধরনের সুস্পষ্ট চিন্তার ব্যাকরণ খাটিয়ে সরল সমাধানটা দেখা ও দেখানো। দর্শন-দর্শন হচ্ছে সত্য-সাক্ষাৎ ঘটানো, যে সত্য ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে প্রভাবিত করবে পুরো জনগোষ্ঠির চিন্তাকাঠামোকে, দেবে নতুন আদল, দেবে জীবনের স্বদেশীয় সংজ্ঞা, দেবে বেঁচে থাকার সময় ও স্থান-উযোগী অভিনব পন্থা বা উপায়। দর্শন বিভাগের ভাটার কথা আরো জোয়ার হয়ে রাষ্ট্র হয়, আরোও উলঙ্গ হয় যখন দেখা যায় তাদের কেউ সমাজ-সংস্কৃতির বা রাষ্ট্র-অঙ্গের ঐতিহাসিক দৈন্য উতরানোর পথ বাতলাতে অপারগ, বারবার। তাদের কথা ঠাঁই পাচ্ছে ক্লাসে বা ডিসারটেশানে, কিন্তু ব্যবহারিক জায়গায় তাদের ছেড়েও এগিয়ে যাচ্ছেন সাহিত্য ও সমাজ তত্ত্ববিদেরা। অথচ এদেরই হবার কথা ছিল চিন্তা-চেতনার জায়গা থেকে অগ্রসর।  

দুঃখিত নিৎশে, আজ বাংলাদেশে কোন কিছু যদি উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে মরে পড়ে থাকে তবে তা অন্য কিছু নয়, দর্শন নিজেই। ‘দর্শনের দাম নাই’-এটা এখন আমাদের খুব পরিচিত বুলি, আর এই বুলির বলেই দর্শনদৃষ্টিহীন হয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সরকারি দোসরদের নিয়ে; যারা বাজারমূল্যহীনতার অবজ্ঞা কাঁধে নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে লজ্জায়। যে জাতি দর্শনের মূল্য বোঝে না, যে জাতির ইতিহাসে কোনো দার্শনিকের পদচিহ্ন নেই, সে জাতি স্বাধীন হতে পারে, পেতে পারে স্থূল উন্নতি (বা তার অস্পষ্ট ছোঁয়ামাত্র), তবে সে জাতি কখনও হতে পারবে না অনুকরণীয়।  

সভ্যতার পত্তন হয় অসভ্যতা কেন কাম্য নয় সে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে। আমরা দেশ পেয়েছি। কিন্তু একটি প্রশ্ন না চাইলেও সামনে এসে যায়: আমরা কি একটি সভ্যতা অর্জন করেছি আজও, যাকে ‘বাংলাদেশি সভ্যতা’ নামে আখ্যায়িত করা যায়?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালনসহ যাঁদের আমরা মনীষী বলে চিনি, তাঁরা তবে কি ছিলেন? তাঁরা কবি ছিলেন, গীতিকার ছিলেন, নাট্যকার ছিলেন, ধ্যানী ছিলেন, সাধক ছিলেন, ছিলেন কালোত্তীর্ণ কিছু কথার অসম্ভব প্রতিভাবান রচয়িতা। তাঁরা গানে-গানে ছন্দে-ছন্দে ব্যক্তিমনে দর্শনগভীর সত্যের চারা রোপণ করেছেন। তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু মানতেই হবে তাঁরা প্রকৃত অর্থে ‘দার্শনিক’ ছিলেন না, ছিলেন না ’৭১-এর প্রত্যক্ষদর্শী বা সমসাময়িকও, জানতেন না ‘বাংলাদেশ’ নামটি।  
অপরদিকে এ. কে. ফজলুল হক এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম না নেওয়া অমার্জনীয় অপরাধ। ’৪৭-পূর্ববর্তী-পরবর্তী সময়ে তাঁদের ও বঙ্গবন্ধুর সম্মিলিত রাজনৈতিক, সর্বোপরি সামাজিক, চিন্তাতেই সুপ্ত ছিল বাংলাদেশের বীজ। কিন্তু এ মহাপুরুষেরা এসেছিলেন অস্থির এক সময়ে—তিনটি রাষ্ট্রের কোন্দল-কেন্দ্রে; আর তাই রাষ্ট্রকাঠামো, সমাজতত্ত্ব ও রাজনৈতিক ব্যাপার ছাড়া খুব বেশি কিছু নিয়ে চিন্তার সুযোগ বা ফুরসৎ কোনোটাই পান নি তাঁরা। এদের বাইরে  আরও যাদের নাম আসে বাংলাদেশে দর্শন-চিন্তা নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁদের একজন হলেন ফরিদপুরের রত্ন নলিনী কান্ত গুপ্ত। তিনি ছিলেন শ্রী অরবিন্দের শিষ্য, অন্য কথায় চক্রমুক্তির খাতিরে ধ্যান ও মা-মগ্ন একজন সাধক। আলিপুরের নাম আসলে আসে তাঁর নাম, কিন্তু পণ্ডিচেরিতে অরবিন্দ-আশ্রমে গেঁড়ে বসা এই মনীষীর ‘বাংলাদেশ’ নিয়ে কোনো চিন্তার নজির পাওয়া প্রায় অসম্ভব। গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জিসি দেব)ছিলেন একজন অসম্ভব প্রজ্ঞাবান দর্শন বিশারদ। তিনি ’৭১ সমসাময়িক কিন্তু ২৬ মার্চ সকালেই পাক-বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে এই মানবতাবাদীকে। আমাদের ছিলেন ‘বিশ্ব-সচেতনতা’ এবং ‘আত্ম-সংরক্ষণ’-এর দর্শন-দ্রষ্টা মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ। ছিলেন সর্দার ফজলুল করিম (যিনি বাঙালি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন দর্শনকোষ), আছেন আখতার ইমাম যাঁদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব (বিশেষ করে ফজলুল করিমের) অনস্বীকার্য। তিনজনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অতুলনীয়। তাঁদের প্রভাবশালী চিন্তা রয়েছে (যদিও যে অর্থে আমি পুরোদস্তুর ‘দার্শনিক’ কথাটা ব্যবহার করছি সেই অর্থে যথেষ্ট নয়), রয়েছে সমাজকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাবার মতন রসদ। তারপরও তাঁদের মৌলিকতার স্তুতি হয়েছে, হয়নি প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক প্রয়োগ। তাঁরা গণমাধ্যমের রঙিন পর্দায় প্রবেশের সুযোগ পেয়েও মূলধারার নীতিনির্ধারক হতে পারেননি, হতে চানওনি হয়তো। এখানেই ভুল।  

কেউ কেউ বলে থাকেন: প্রকৃত বোদ্ধাদের পদচিহ্নহীন মূলধারা বা রাজনীতি এখন হয়ে গেছে শকুনাক্রান্ত নোংরা পল্লি। এ সুযোগ নষ্টরা ছাড়বে কেন যখন বিনষ্টি ও ফায়দা লুটাই তাদের হিজেমনির অন্তর্লক্ষ্য? সাঈদের সতর্কবাণী না শুনে এখন আর কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন:’ I am interested in . . . suggesting how the general liberal consensus that ÔtrueÕ knowledge is fundamentally non-political . . . obscures the highly if obscurely organized political circumstances obtaining when knowledge is produced. No one is helped in understanding this today when the adjective ÒpoliticalÓ is used as a label to discredit any work for daring to violate the protocol of pretended suprapolitical objectivity.Ó.” (সাঈদ, ওরিয়েন্টালিজ্ম, পৃ: ১০)
আমদানির প্রবণতাতলে আজকে বাংলাদেশে মৌলিকতার মৃত্যু ঘটেছে। ধারসংস্কৃতির প্রবাহে কখন আমরা জাতির-জনকের বাকশাল ভুলে পশ্চিমা গণতন্ত্রের মন্ত্রে বুঁদ হয়েছি তাও জানি না। লাল মাটির গাছ উপড়ে এনে এঁটেল মাটিতে পুঁতলে যে তা বাঁচবে না, ওটুকু বোঝার বুদ্ধি বাংলাদেশিদের হয়েছে এটা নিশ্চিত। আমাদের প্রচণ্ডভাবে দরকার রয়েছে দর্শন বিভাগের গম্ভীর ব্যাকরণ, সেই সাথে দরকার রয়েছে রবি-লালনের অন্তর্ভেদী সরলতা, যা পৌঁছে যায় জীবনের অলিগলিতে। এই দুয়ের মিশ্রণেই শুধু আমরা পারি পারমাণবিক মানুষের জন্ম দিতে, যে মানুষ হবে নতুন মানুষ, হবে সৃষ্টির নেশায় বিভোর; যে মানুষ দর্শন দিয়ে নিজস্ব বুদ্ধির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রভাবিত করবে পুরো জাতি ও বহির্জগৎকেও। সেই জন্য স্থান ও সময়োপযোগী তত্ত্বজ্ঞান সৃষ্টির প্রকল্পে দরকার দর্শন বিভাগগুলোর আরোও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আর তা করতে সরকারি মদদ দরকার; দরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও মানবিক ও জ্ঞানকেন্দ্রিক সচেতনতা। সেইদিন বাংলাদেশ সামগ্রিক অর্থে হবে উন্নয়নশীল যেদিন বিজ্ঞান, সাহিত্য-সমাজ-রাজনীতি তত্ত্বের পাশাপাশি দর্শনশাস্ত্রেও তৈরি হবে তার সমান পারদর্শিতা। পারমাণবিক মানুষের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। স্বাধীন-স্বতন্ত্র বাংলাদেশের অপেক্ষায় এর সাধারণ জনগণ।

লেখক
হিশাম ম. নাজের
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪১ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।