চট্টগ্রামে রথযাত্রার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এই রথের উৎসবের কারণে এখানকার একটি স্থানের নামকরণও হয়েছে ‘রথের পুকুর পাড়’ নামে।
উড়িষ্যার পুরীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থপীঠ জগন্নাথ মন্দিরের অনুকরণে ১৮শ’ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে পাহাড়-সমুদ্রে ঘেরা চট্টগ্রামে শুরু হয় রথযাত্রা উৎসব। শহরের নন্দনকাননে পাহাড় শিয়রে স্থাপিত তুলসীধামে শ্রীশ্রী মদনমোহন নরসিংহ গোপাল জীও’র মন্দিরে ভগবান জগন্নাথ-সুভদ্রা মহারাণী ও বলরামের শ্রীবিগ্রহের নিত্য পূজা চলে।
তুলসীধামের মোহন্ত শ্রীমৎ দেবদীপ পুরী মহারাজ জানান, ‘আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে শিবকল্পতরু শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ শহরে রথযাত্রা উৎসব শুরু করেন। তার প্রয়াণের পর শ্রীমৎ স্বামী অচ্যুতানন্দ পুরী মহারাজ এবং পরবর্তীতে ঋষিপুত্র শ্রীমৎ স্বামী নারায়ণ পুরী মহারাজ সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। এই রথযাত্রা দুইশ বছরেরও প্রাচীন। কালের পরিক্রমায় এটি এখন চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় রথযাত্রায় রূপ নিয়েছে। ’
তৎকালীন সময়ে তুলসীধামের রথযাত্রার দিন রথের পুকুর পাড় এলাকায় শহরের বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের রথ ছাড়াও আশপাশের উপজেলা থেকে রথগুলো এসে জমা হতো, বসতো মেলা। পুকুরে পূণ্যস্নান করতেন ভক্তরা। সবগুলো রথ পুকুর পাড়ে রাখা হতো বলে স্থানটিও সেই নামে পরিচিতি পায়। একাদশী তিথিতে প্রত্যাবর্তন বা ফিরতি রথের দিন পর্যন্ত রথগুলো সেখানেই থাকতো। কিন্তু বর্তমানে পুকুর পাড় ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন আর দোকান-পাট।
ফলে বিভিন্ন মন্দিরের রথগুলো পরিক্রমা শেষে আবারো ফিরিয়ে নেয়া হয়। বর্তমানে কেন্দ্রীয় রথযাত্রা উৎসবে যোগ দিচ্ছে- তুলসীধামের রথ, শ্রীকৃষ্ণায়ন, মনোহরখালী, টেকপাড়া, সদরঘাট মাইজপাড়া, শাহাজীপাড়া, পার্বতী ফকির পাড়া, কেদারনাথ তেওয়ারী কলোনী, টাইগারপাস জগন্নাথ সংঘ, সুপ্রভাত বয়েজ ক্লাব, গঙ্গাবাড়ী, পাথরঘাটা গিরিধারী মন্দির ও ইপিজেড শ্রীকৃষ্ণ মন্দির সহ বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের রথ।
এ উপলক্ষে তুলসীধামে দিনব্যাপী আয়োজন করা হয় নামকীর্তন, অঞ্জলি প্রদান, প্রার্থনা ও ভোগারতিসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির। দিনব্যাপী বিতরণ করা হয় মহাপ্রসাদ। অদ্বৈত-অচ্যুত মিশনের আয়োজনে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শঙ্খ ও উলুধ্বনি সহকারে ধূপের আরতিতে সুদৃশ্য রথে চড়িয়ে ত্রিদেবতা নিয়ে পথ পরিক্রমায় বাহির হন লাখো ভক্তবৃন্দ।
চট্টগ্রামের পাথরঘাটা রাধাগোবিন্দ ও শান্তনেশ্বরী মাতৃমন্দিরের মোহন্ত শ্যামল সাধুর পৌরহিত্যে এবং গোলপাহাড় মহাশ্মশান কালী বাড়ি, গৌর গিরীধারী মন্দির, চকবাজার জগন্নাথ মন্দির পরিচালনা কমিটির উদ্যোগেও প্রতিবছর এই সময়ে অনুষ্ঠিত হয় রথযাত্রা। উৎসবের মহাশোভাযাত্রায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং ধর্মীয় সংগঠনও যোগ দেয়।
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) এর প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ভারতবর্ষের বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই উৎসবের প্রচলন করেন। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে প্রথম রথযাত্রা উৎসবের সূচনা হয়।
ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ শ্রীপাদ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী জানান, ‘১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামে ইসকনের উদ্যোগে শুরু হয় রথযাত্রা উৎসব। শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য নিষ্টুলা দাস ব্রহ্মচারী ও চট্টগ্রাম ইসকনের অন্যতম রূপকার শ্রীপাদ শ্রীহরি দাস অধিকারী রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেছিলেন’।
তিনি জানান, নগরের জেএমসেন হলে বাঁশের তৈরি রথে মাঝখানে জগন্নাথ, একপাশে বড় ভাই বলরাম ও মাঝে বোন সুভদ্রা মহারাণীকে বসিয়ে রথ পরিক্রমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রবর্তক মন্দির থেকে ২০০৩ সালে বৃহৎ পরিসরে তিনটি সুদৃশ্য রথ নিয়ে শুরু হয় এ উৎসব। বর্তমানে এই রথযাত্রা বিশাল মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে।
নগরের নন্দনকানন শ্রীশ্রী রাধামাধব মন্দির ও গৌরনিতাই আশ্রমের আয়োজনে বিভাগীয় ইসকনের উদ্যোগে গত ৩ বছর ধরে আলাদাভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে রথযাত্রা উৎসব। এছাড়া চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলার মধ্যে অধিকাংশ থানা এলাকার মন্দির কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রতিবছর।
শাস্ত্রবিদরা বলছেন, যিনি জগতের নাথ, তিনিই জগন্নাথ। পুরী মানে দেহপুরী। তাতে অধিষ্ঠিত নাথ জগন্নাথ। রথের দুই রজ্জু দুই শ্বাসগতি। জগন্নাথ দেহমধ্যে থাকলে শ্বাসগতি চলে।
কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, আমাদের শরীর-রূপ রথ বিজয়পথে অবিরাম ছুটে চলেছে। মানবদেহের ইন্দ্রিয়গুলো এই রথের ধাবমান ঘোড়া। আমাদের বুদ্ধি-রূপ সারথি, জন-রূপ লাগাম জুড়ে দিয়ে ইন্দ্রিয়-রূপ ধাবমান ঘোড়াগুলোর গতিকে সবলে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। আর সেই রথের অধিপতি হচ্ছেন আত্মা, যা অচঞ্চল শান্ত মূর্তিতে রথোপরি বিরাজিত। রথের গতিবেগ তাঁকে আদৌ স্পর্শ করছে না।
লেখক: সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৯
এসি/টিসি