রানী ভিক্টোরিয়ার বড় পছন্দ ছিল অ্যালবার্টকে। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের রীতি অনুযায়ী ক্ষমতায় থাকা রানী কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারেন না।
প্রেমের জন্য সিংহাসন ছেড়েছিলেন ব্রিটেনের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড। আর রানী ভিক্টোরিয়া ব্রিটিশ রাজসংস্কৃতি উপেক্ষা করে বিয়ের প্রস্তাব দেন অ্যালবার্টকে। কেঁপে ওঠে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের ট্র্যাডিশন। বিস্ময় কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত এই বিয়ে হলো। কিন্তু শান্তি এলো না। ব্রিটেনের মানুষ অ্যালবার্টকে গ্রহণ করল না। তিনি রাজাও হতে পারেননি। এক ধরনের মানসিক অস্বস্তি ছিল জীবনযাত্রায়। বিষন্নতাও ছিল। অস্বস্তি নিয়ে অ্যালবার্ট অসুস্থ হতেন মাঝে মাঝে। কিন্তু টিকতে পারলেন না শেষ পর্যন্ত। ১৮৬১ সালে মারা যান মাত্র ৪২ বছর বয়সে। এ মৃত্যু রানীকে দারুণভাবে আহত করে। তীব্র বেদনায় দগ্ধ রানী ভেঙে পড়েন। শোকের প্রতীক হিসেবে কিছুদিন কালো পোশাক পরার কথা। কিন্তু কোনোভাবে শোক কাটাতে পারছিলেন না রানী। তাই বাকি জীবন কালো পোশাক পরে কাটিয়ে দেন।
হায় স্মৃতি বড় কষ্টের। এ কষ্ট হৃদয়ে একবার গেঁথে গেলে আর সরতে চায় না। ফাগুনী নাটকে কবিগুরু বলেছেন, ‘জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার পরিচয় পেতে হবে। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের পরে তার যথার্থ শ্রদ্ধা নেই বলেই জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দী করতে ছুটেছে, সে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন। ’
আরব বিশ্বের সম্মানিত একজন কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছেন, ‘আমি এমন মৃত্যু পাইনি যাতে আমি জীবনকে শিকার করি, আমি এমন কণ্ঠ পাইনি যাতে আমি চিৎকার করে বলি: হে দ্রুতগামী সময়। তুমি আমাকে নিয়ে গেলে তা থেকে রহস্যময় হরফরা যা আমাকে বলেছিল, বাস্তবতা সে তো দূর কল্পনা। ’
এক জীবনের অনেক কিছু দেখে যেতে হয়। সহ্য করতে হয়। বোধশক্তিহীন মানুষদের কোনো সমস্যা নেই। বিবেক থাকলেই ঝামেলা। বিবেকের আগুন দাহ করে। পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাই করে। আবার শ্বাস থাকলে মোকাবিলা করতে হয় জগৎ-সংসারের সব কাঠিন্য। সেই কাঠিন্যকে জয় করতে গিয়ে ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হক।
নিজের শহরকে বদলাতে গিয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে হিরো হন মেয়র জুলিয়ানি। তছনছ করে গুঁড়িয়ে দেন মাফিয়াতন্ত্র। মাদক আর সন্ত্রাসকে শেষ করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসেন আইনের শাসন। মানুষের হারিয়ে যাওয়া আস্থা ফিরিয়ে আনেন। আমাদের মেয়রদের এত ক্ষমতা নেই। এত জৌলুস নেই। এখানে হিরো হওয়া এত সোজা কথা নয়। আত্ম-অহমিকা আর দাম্ভিকতা থাকলেও হিরো হওয়া যায় না। এর বাইরে ৫৪ সংস্থার উন্নয়নের জোয়ারে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে উঠতে হয়। তার পরও মানুষ চাইলে পারে অনেক কিছু করতে।
আনিসুল হকের দাম্ভিকতা ছিল না। নগরবাসীর জন্য আন্তরিকতা ছিল। নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজটুকু করার চেষ্টা করেছেন। অন্যায় ও অসংগতিকে ‘না’ বলতে চেষ্টা করেছিলেন। একটা সাহস ছিল, দৃঢ়তা ছিল। অহমিকা ছিল না। দাম্ভিকতা ছিল না। কাজটা বুঝতেন। না বুঝলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতেন।
এখন চেয়ার পাওয়ার আগেই সবাই দাম্ভিক। পেলে তো কথাই নেই। অনেকে অহমিকার কারণে কথা বলতে পারেন না। এরও কারণ আছে। কারণটা হলো, কাউকে ভোটারদের কাছে যেতে হয় না। তাই জগৎ-সংসারকে রঙিন মনে হয়।
আনিসুল হকের বিনয় ছিল। তিনি জগৎ-সংসারের কোনো জটিলতাকে ঠাঁই দেননি। ক্লান্তি তাঁকে থামাতে পারেনি। তেজগাঁওয়ের ট্রাক মাফিয়াজমকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করেন। হুমকি, ঘেরাওকে সাহসের সঙ্গে উড়িয়ে দেন। ঢাকাবাসীর জন্য সড়কগুলো উদ্ধার করেন। রাজপথের ময়লা পরিষ্কারকরণে আনেন আধুনিক বাহন। পানি ছিটানোর জন্যও আলাদা গাড়ি। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে শুরু করেন সিটিকে সিসি ক্যামরার আওতায় আনার প্রক্রিয়া। জানতেন পুলিশ তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই বলে অপরাধী শনাক্তে সিসি ক্যামেরা আনবেন না কেন?
নির্দিষ্ট একটি এলাকা প্রথম বেছে নেন। ঢাকা উত্তর ঘিরেই ছিল প্ল্যান। গুলশান-বনানী এলাকায় চালু করেন বাস সার্ভিস। উত্তরা, মিরপুরের সড়কগুলোকে প্রসারিত করেন। ২৪ ঘণ্টাই ভাবতেন নগরবাসীকে নিয়ে। আমাদের এমন দুজন মেয়রই প্রয়োজন। সেই মেয়ররা নির্বাচিত হবেন জনগণের ভোটে, রাত বা দিনের আলো-আঁধারিতে নয়। মানুষের প্রত্যক্ষ ভোটে।
নগরবাসীর ভোটাধিকার ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের ইমেজ রক্ষা করতেই সিটি ভোট নিরপেক্ষভাবে করার বিকল্প নেই। সমস্যা কী? মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক না ভোটের উৎসব। জয়-পরাজয়ে সরকারের শাসনে কোনো প্রভাব পড়বে না। এর আগেও বিএনপি সব সিটিতে ছিল। সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। আবার বিএনপির শাসনে আওয়ামী লীগ সিটিতে ছিল। উন্নয়ন ব্যাহত হয়নি। সরকারের কোনো কাজে সমস্যা হয়নি। বরং মেয়র সাহেবরা তটস্থ থাকতেন। ভয়ে থাকতেন জনগণের কাজ বাস্তবায়ন আর জবাবদিহি নিয়ে।
আওয়ামী লীগ গণমানুষের রাজনৈতিক দল। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানামুখী প্রশ্ন আছে। এ প্রশ্নের জবাব এড়াতেই দরকার নিরপেক্ষ সিটি ভোট। জনগণ যাকে খুশি ভোট দেবে। কোনো বিতর্কের দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা এ দেশের মানুষকে ভোট ও ভাতের অধিকার দিয়েছেন। অতি উৎসাহীরা সর্বনাশ করে। গত ভোটেও করেছিল। এর ধারাবাহিকতা দেখতে চাই না।
বিশ্ববাস্তবতায় সরকারকে এ মুহূর্তে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। তাই আবারও বলছি, সিটি ভোট হোক নিরপেক্ষভাবেই। মানুষের আস্থা বাড়বে। অতি উৎসাহীদের অতীতের কাজগুলো ভুলে যাবে। বিশ্বাস করি নগরবাসীর সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষেই থাকবে। বারবার একই ভুলের সঙ্গে বসবাসের কোনো দরকার নেই।
একটি ভুল টেনে আনে আরেকটিকে। কোনো ভুলের পরিণতিই ভালো হয় না। এ জগৎ বড়ই রহস্যময়। আজ যা বাস্তব, কাল তারও হিসাব-নিকাশ দিতে হয়। কোনো কিছুই হিসাবের বাইরে নয়। যৌবনে জানা অনেক কিছু মধ্যবয়সে ভুল মনে হচ্ছে। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের প্রেমে তরুণ বয়সে কমবেশি অনেকেই পড়ে। এ বয়সে এসে আকবর আলি খানের লেখা পড়ে আছি আরেক যন্ত্রণায়।
আকবর আলি খান ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ দিয়েছেন, বনলতা সেন অন্ধকার জগতের কেউ। হায়! কি রাজনীতি, কি সমাজ সবখানে একটা বয়স কেটে যায় বিভ্রান্তির মাঝে। আর যখন মানুষ সব বুঝতে পারে তখন আর ফেরার পথ থাকে না। অন্ধকার গলিতেই পড়ে থাকতে হয়। আলো-আঁধারির হাসি-কান্নায় কাটিয়ে দিতে হয় বাকি জীবন। হৃদয়ের অব্যক্ত আগুনে তিল তিল করে পুড়তে হয়। এ আগুন চোখে দেখা যায় না। শুধুই অনুভবে থাকে। বেদনার নীল কষ্টগুলোকে বুকে নিয়েই একটা পর্যায়ে চলে যেতে হয়।
আমার এক সিনিয়র বন্ধু ছিলেন ৭৩ ব্যাচের সরকারি কর্মকর্তা। দেশ-বিদেশ আমরা অনেক ঘুরেছি আমাদের আরেক বন্ধুকে নিয়ে। সে দুজনই চলে গেছেন। একজন ব্যাংকক গেলেন কাজে। মোটরসাইকেলের ধাক্কায় রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন আর উঠলেন না। আর ৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা বয়সে সিনিয়র বন্ধুটিকে মাসতিনেক আগে দেখতে গিয়েছিলাম। তার সন্তানরা জানালেন, এখন কাউকে চিনতে পারেন না। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ কাবু করে ফেলেছে। আমাকে দেখেই চিনলেন। বললেন, বড় তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেলাম। চলে যাব যে কোনো সময়। সত্যি সত্যি কিছুদিনের মধ্যে চলে গেলেন।
জানাজায় গিয়ে মনে পড়ল, ’৯৮ সালের লন্ডনের কিছু স্মৃতি। গাড়ি চালাচ্ছেন সানু মিয়া। পেছনের আসনে আমার সেই দুই বন্ধু। সানুর পাশে সামনের আসনে আমি। কত গল্প, কত আড্ডা। চারজনের তিনজনই নেই। চলে গেছেন। আমি আছি। বেঁচে আছি।
একটা কচ্ছপ বাঁচে সাড়ে তিন শ বছর। আর মানুষের আয়ু এত কম কেন? জীবন নিয়ে শেষ মুহূর্তে সবাই আফসোস করে। অনেকে সেই সময়ও পায় না। চলে যায় হুট করে। মিথ্যা অহংকার নিয়ে বেঁচে থাকি সবাই। একবারও বুঝতে চাই না, চলে গেলে সব শেষ! কেউ মনে রাখতে পারে আবারও না-ও রাখতে পারে। তাই তো জীবনের শেষ প্রান্তে কবি নজরুল আক্ষেপ নিয়ে লিখেছিলেন, ‘যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে! দেশপ্রেমী, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী- বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা! এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু, তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বলো- বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি। ’
কোলাহল ব্যস্ত জীবনে কবি নজরুলও একজন বন্ধুর সন্ধানে ছিলেন আলাদা করে। যিনি তাঁর কথা ভাববেন সবার চেয়ে অন্যভাবে। জানি না সেই বন্ধু নজরুল পেয়েছিলেন কিনা। খেয়ালি ছিলেন বিদ্রোহী কবি। যখন যা মনে আসত তা-ই করতেন। ভীষণ কষ্টের জীবন ছিল। কিন্তু সবকিছুকে তছনছ করে সামনে চলতেন। মনের দাহন ছিল। সমাজ, রাজনীতি কোনো কিছুই ভালো লাগত না। এর মাঝে বাড়তি ভোগান্তি ছিল অর্থকষ্টের। তার মাঝে সামান্য অর্থ এলে দুই হাতে খরচ করতেন। আগামীর কথা ভাবতেন না।
একবার বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন, ‘ট্রামে যাতায়াত কর না কেন? ট্যাক্সিতে তো খরচ বেশি। ’ জবাবে বলেছিলেন, ‘এই ট্রামে টিকিরটিকির করে চললে মনে হয় জীবন বড্ড ধীরস্থির হয়ে যাচ্ছে। গতিই আমাকে কষ্ট-যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। ’
এ গতির জন্যই কবি নজরুল ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ক্রাইসলার গাড়িও কিনেছিলেন। অথচ বাকি টাকা শোধ করার ক্ষমতা ছিল না। স্বপ্ন ও বাস্তবতায় অনেক ফারাক থাকে। তবু এ জগৎ-সংসারে আমরা একটা গতির সন্ধানে ঘুরে বেড়াই। অথচ বুঝি না একদিন এ গতি থেমে যাবে। শেষ হয়ে যাবে সবকিছু। কিছুই থাকবে না। আমরাও থাকব না। যাওয়ার পর কেউ আলাদা করে মনে রাখবে কিনা তাও জানি না। ইট-পাথরের এ শহর বড্ড নিষ্ঠুর! এখানে কেউ কাউকে মনে রাখে না। কোনো কিছুই কারও জন্য থেমে থাকে না। তার পরও জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার জন্য আমরা শুধুই লড়াই করে চলি।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২০