ওই রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে স্বাধীনতাবিরোধীদের বর্বোরোচিত আক্রমণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যরা শহীদ হন। বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা।
শোকাবহ আগস্ট স্মরণে শনিবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে আয়োজিত দোয়া ও স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বউ সাহান আরা বেগম এভাবেই সেই দিনের স্মৃতিচারণ করেন।
জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে কলঙ্কিত অধ্যায় ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নাজরিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ভোররাতে ফজরের আজানের কিছু সময় পর হঠাৎ করেই প্রচণ্ড শব্দে বাড়ির সবার ঘুম ভেঙে যায়। সবাই বুঝলাম গুলির শব্দ হচ্ছে। দৌড়ে সন্তানদের নিয়ে আমার শ্বশুর ও তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের কক্ষে যাই।
‘তখন আমার শাশুড়ি আমেনা খাতুন তার ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফোন দিতে বলেছিলেন শ্বশুরকে। এরপর একই কথা আমাকে বললে-আমিও মণি ভাইকে ফোন দিই। তিনি দেখতে বলেছিলেন কারা? কিন্তু অনবরত গুলি ছোড়ার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে ঘাতকেরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে এবং আমার শ্বশুরের কক্ষ থেকে সবাইকে নিচে নামিয়ে নেয়। ’
সাহান আরা আব্দুল্লাহ বলেন, নিচে নিয়ে ঘাতকেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে বাড়ির আর কোনো সদস্য বাকি আছে কি-না? তখন আমি শ্বশুরের দিকে তাকাতেই বুঝে যাই যে, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কথা যেন না বলি। সেদিন বাসায় থাকা ক্রিসেন্ট ব্যান্ড দলের সদস্যদেরও আমাদের পাশে এনে দাঁড় করানো হয়।
‘তবে এর মাঝেই আমার শ্বশুর ঘাতক সৈন্যদের বলেন- তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে? আমি তার সঙ্গে কথা বলবো? এ সময় দলছুট সেনারা জানায়, তাদের কোনো কমান্ডিং অফিসার নেই। আর এরপরই শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। ’
তিনি বলেন, আমার বড় ছেলে সুকান্ত বাবু আমার কোলে উঠতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমার কোলে ছিলো বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ও ওই সময়ে দেড় বছরের শিশু সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। সুকান্তর আকুতিতে তাকে কোলে তুলে নেন আমার ভাসুর শহিদ সেরনিয়াবাত ভাই।
‘আর আমার স্বামীকে (হাসানাত আবদুল্লাহ) না দেখলেও, সেনা সদস্যরা সুকান্ত বাবুকে শহিদ ভাইয়ের কোলে দেখে তাকেই হয়তো ওরা হাসানাত ভেবেছিলো! তাই তার পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে ব্র্যাশ ফায়ার করে ঘাতকেরা। তিনি মুহূর্তের মধ্যেই সুকান্তকে নিয়ে উপুর হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আর আমার শ্বশুরকে দেখেছি তার বুকে হাত দিয়ে চেপে রাখতে, কারণ সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড় হচ্ছিলো। সবাইকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে চলে যাওয়ার পরে আবারো ঘাতকেরা বাড়ির ভেতর ঢোকে এবং সবার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আবারো গুলি চালায়। ’
ওইদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সাহান আরা বলেন, সেদিনের ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে আমাদের বাড়িতে আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ছাড়াও শহীদ হন আমার শিশুপুত্র সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত, ননদ বেবী সেরনিয়াবাত, দেবর আরিফ সেরনিয়াবাত, ভাসুর শহিদ সেরনিয়াবাত ও আবদুল নঈম খান রিন্টু। আর আহত হন আমার শাশুড়ি, ননদ ও ক্রিসেন্ট ব্যান্ডের সদস্যসহ আরো অনেকে। আমি আহত হয়েছিলাম। ’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বরিশাল-১ আসনের (আগৈলঝাড়া-গৌরনদী) সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী সাহান আরা বলেন, ঘাতকেরা চলে যাওযার পর আমার স্বামী (হাসানাত আব্দুল্লাহ) বের হয়ে আসেন। বাবার হাতে পালস ধরেই নির্বাক হয়ে বসে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে বাসায় রমনা থানার তৎকালীন ওসি আসেন। তিনি শ্বশুরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বলা হলো, বেঁচে নেই। এরপর তিনি আমার স্বামীকে বললেন- আপনি কে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, এ বাড়ির বাবুর্চি। কিন্তু ওসি তাকে চিনতে পারেন। ওই সময় ওসি বলেছিলেন, আপনি পালিয়ে যান, এদের আমি দেখছি।
‘এরপর সেই ওসি পুলিশের জিপে করে আমাদের নিয়ে যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দীর্ঘ কয়েকমাসের চিকিৎসা শেষ করেও পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে আমাদের। ’
১৫ আগস্টে ঘাতকের আক্রমণে আহত সাহান আরা বলেন, আমার শাশুড়ি হাসপাতালের খাবার খেতে পারছিলেন না। এক নার্সের সহায়তায় আমার হাতের একখানা বালা বিক্রি করে গ্লুকোজ কিনে এনেছিলাম। আমাদের যখন সবার নাম কাটবে ঠিক করা হলো, ঠিক তখন শুনলাম শুধু আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে ক্যান্টনমেন্টে। অনেক তদবির করে রক্ষা করা হয়েছে।
‘এদিকে ঘটনার কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও স্বামী-সন্তানদের খোঁজ পাইনি। পরে জানতে পারলাম, স্বামী পার্শ্ববর্তী মিত্র দেশে আছেন। আর আমার দুই শিশু সন্তান কান্তা আর সাদিক নানা-নানির সঙ্গে গ্রামের বাড়ি বরিশালে রয়েছেন। গাড়ির শব্দ পেলেই সাদিক আর কান্তাকে ঘরের কার্নিশে লুকিয়ে রাখা হতো। ’
সাহান আরা আব্দুল্লাহ বলেন, সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়ি যাই। এক পর্যায়ে সন্তানদের নিয়ে কোনোভাবে মিত্র দেশে (ভারত) গিয়ে আশ্রয় নিই, সেখানেই ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বামীর সঙ্গে ওই ঘটনার পর প্রথম দেখা হয়। যদিও এর আগে আমাদের বাকি স্বজনেরা মিত্র দেশেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ সবাই আমাদের খুঁজছে। আমাদের কারণে আমার বাবা কাজী মোখলেছুর রহমানকেও জেল খাটতে হয়েছে আড়াই বছর।
‘আমরা কেউ-ই সেদিনের কথা ভুলতে পারিনি। সেদিনের সবথেকে বেশি ক্ষত, ১৩টি বুলেটের ক্ষত নিয়ে আজও বেঁচে আছেন ননদ বিউটি। আর আমার স্বামী হাসানাত আবদুল্লাহ অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। পরে জেনেছি, সেদিক সেনারা যখন উচ্ছ্বসিত হয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়, তখন শেখ ফজলুল হক মণির বাসার একটি ফোনের কারণে তিনি বেঁচে যান। সে ফোনটিতে কথা বলতে গিয়ে তিনি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যে কারণে সেনারা তাকে দেখতে পায়নি,’ যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৯
এমএস/এমএ