ভেতরে দু’জন তরুণী বসা। এগিয়ে যেতেই মিষ্টি হাসি দিয়ে কতগুলো লিফলেট বাড়িয়ে দিলেন গ্লাসের ফাঁক গলে।
কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন, যেতে কত খরচ হতে পারে, কেনো যাবেন, গেলে কি কি দেখতে পাবেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। সঙ্গে যোগাযোগ মাধ্যমের আদ্যোপান্ত। এমনকি কোন ধরনের ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করলে কত সময় প্রয়োজন হবে, খরচের ব্যবধান কেমন হবে সবই।
কাউন্টারে বসা সেই তরুণীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে গেলে বেশ আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিচ্ছিলেন। আলাপচারিতার মধ্যেই আরও কয়েকজনকে এমনিভাবে লিফলেট তুলে দিলেন। অর্থাৎ, কথা-কাজ সমান তালে চলছে।
কাউন্টারে বসা একজন জানালেন তার নাম জান্নাহ। পড়াশোনা শেষ হয়নি, ট্যুরিজমের উপর ইন্টার্নশিপ করছেন। তারই অংশ হিসেবে এই কাউন্টারে সার্ভিস দিচ্ছেন।
মালয়েশিয়া ট্যুরিজম অ্যান্ড কালচার মন্ত্রণালয় পরিচালিত এ কাউন্টারটি প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তারাও রোস্টার অনুযায়ী ডিউটি করেন।
আবার ‘লাকম ইনন’ হোটেলে যখন ঢুকছিলাম তখন দেখলাম রিসিপশনের একই ধরনের লিফলেট থরে থরে সাজানো। লাকম ইনন থেকে ওইভাবে যেচে কাউকে দেওয়া হয় না। একজন প্রশ্ন করলেন, কেএল সেন্টার কীভাবে যাব, রিসিপশনিস্ট হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা সিটি ম্যাপটি মেলে ধরলেন।
সুন্দর করে বুঝিয়ে ম্যাপটি দিয়ে দিলেন। বললেন এখানে ট্যুরিস্ট স্পটের তথ্য সম্বলিত লিফলেট রয়েছে, আপনি চাইলে নিতে পারেন। এখানেও নাকি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক প্রাইভেট স্পট রয়েছে যারা নিজের তৈরি লিফলেট দিয়ে গেছেন। প্রায় ছোট-বড় সব হোটেলেই এমন ফ্রি লিফলেট বিতরণের ব্যবস্থা রয়েছে।
তথ্য তুলে ধরার পদ্ধতি দেখে অবাক হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কল্পনার জগতে ফিরে গেলাম ডিসেম্বরে কক্সবাজার ভ্রমণের কথা। তখন একাধিক হোটেল মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছিল কক্সবাজারের হোটেলের ব্যবসা নিয়ে।
হোটেল মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি-সম্পাদকসহ অনেকেই তখন বলেছিলেন, কক্সবাজারে নাকি চার-পাঁচ দিনের জন্য হোটেল বুকিং দিয়ে এলেও দু’তিন দিন পরেই চলে যাচ্ছেন ট্যুরিস্টরা। এমনকি অনেকে হোটেলের ভাড়া পুরো পরিশোধ করেও ফেরত যাচ্ছেন।
প্রশ্ন ছিল কেন এমন হচ্ছে, তারা একেকজন একেক রকম তথ্য দিয়েছিলেন। তবে কমন ছিল এখানে দু’দিনে ঘোরা-ফেরা শেষ হচ্ছে। একদিন দেখছে কক্সবাজার-ইনানী-হিমছড়ি। দ্বিতীয় দিন সেন্টমার্টিন ঘুরে মনে করছে আর কিছু দেখার নেই। তাই চলে যাচ্ছে।
তাহলে টেকনাফ, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, রামুর ঐতিহাসিক মন্দির সম্পর্কে সম্পর্কে ট্যুরিস্টদের কোনো আগ্রহ নেই? জবাব এসেছিল এ জায়গাগুলোকে বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং করতে পারেনি। আবার যেটুকু হয়েছে সেগুলো ট্যুরিস্টদের নজরে আসছে না।
আরেকটি অবাক করার মতো তথ্য ছিল, কক্সবাজারে যারা ঘুরতে আসছেন, তাদের তথ্যের অন্যতম ভরসা হচ্ছে অটোচালক, রিকশাচালক এবং হোটেল বয়রা। হোটেল থেকে বের হয়ে অটোতে উঠে প্রশ্ন করছে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। প্রথমেই তারা জানাচ্ছে ইনানী এবং হিমছড়ির কথা।
অন্য স্পটগুলোকে তারা কক্সবাজারের মধ্যেই রাখছেন না। এখানে কিছুটা মোহও কাজ করে তাদের মধ্যে। তা হচ্ছে এই স্পটগুলোতে গেলে তারা ওই ট্যুরিস্টকে নিয়ে যেতে পারবেন। এতে কিছুটা আয় রোজগার হবে। কিন্তু অন্যগুলোতে গেলে তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে না, তাই ওইসব স্পটের বিষয়ে তাদের খুব একটা আগ্রহ থাকছে না।
এ কারণে বিভ্রান্ত হচ্ছে দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টরা। আর বিভ্রান্ত হচ্ছেন বলে, পাঁচদিনের বুকিং দিয়ে এলেও দুই কিংবা তিনদিন থেকেই ফিরে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করা হলে কোথাও কিন্তু এমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। না ট্যুরিজম বোর্ড, না পর্যটন করপোরেশন। এমনকি তাদের প্রধান কার্যালয়েও এমন ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশও কিছু কিছু লিফলেট তৈরি করেছিল, কিন্তু সেগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি। হয়তো দেখা যাবে কোন স্টোররুমে গাদা করে ফেলে রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার থেকে যেমন বুকিং বাতিল করে লোকজন ফিরে যাচ্ছে, মালয়েশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হচ্ছে না। বরং এতো সব জানার পর কেউ কেউ ফ্লাইট পরিবর্তন করে বাড়তি সময় থেকে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউতো সব দেখতে না পারার আফসোস নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। যারা আফসোস করছেন তারা ফের মালয়েশিয়া আসবেন এমন সংকল্প নিয়ে যাচ্ছেন।
**প্রবাসীদের সহি আমলনামা-৩
**প্রবাসীদের সহি আমলনামা-২
** মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের সহি আমলনামা
** বুকিত বিনতানের সম্প্রীতি
** মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের আস্থা ‘লাকম ইনন’
** বাংলানিউজের সিরাজ এখন মালয়েশিয়ায়
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
এসআই/এএ