উনিষশ’ পয়ষট্টি সালে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক অবস্থা বা সামাজিক অবস্থা কিছুই ভাল ছিল না। এই জেলে পাড়ায় মাছ ধরা ছাড়া ছিল না কোন আয়ের উৎস।
ছোট এই ভূমিতে মানুষেরই থাকার জায়গা নেই, গাছ লাগাবে কোথায়! জনসংখ্যার ঘনত্বে পৃথিবীর তৃতীয় এই দেশ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৭৭৯৭ জন বাস করেন।
সবাই থাকবেন বাগানে
মূলত ১৯৮০ এর পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে দেশকে সাজাতে উঠে পড়ে লাগে সিঙ্গাপুর। আর তার প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে গাছ। অনেক স্থাপনাকে জায়গা করে দেয়া হয় মাটির নিচে। যেন মাটিতে গাছ লাগানো যায়।
এখানকার ন্যাশনাল পার্কস বোর্ডের জ্যেষ্ঠ পরিচালক ইয়ো মেং তং বলেন, সিঙ্গাপুরে মাত্র একটি বাগান ছিল। এখন ১৩টি। প্রতিটি বাগান একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। মানুষ চাইলে পুরো সিঙ্গাপুর বাগান দিয়েই ঘুরতে পারে।
তিনি বলেন, প্রথমে আমরা চেয়েছি মানুষ তার ৪০০ মিটারের মধ্যে বাগান পাবে। এরপর চেষ্টা করেছি ৪০ মিটারের মধ্যে। এখন আমরা ভাবছি, প্রতিটি ঘরই হয়ে উঠবে বাগান এবং মানুষ বাগানেই থাকবে।
কিভাবে সম্ভব? ইয়ো মেং বলেন, বাড়ির আঙ্গিনায়, ঘরের বারান্দায় এবং উচুঁ স্থাপনাগুলোতে বাগান থাকা আবশ্যক করা হয়েছে। এখন মানুষের বারান্দা থেকে গাছ ঝুলতে দেখা যায়। ফুটপাথের পাশের রেলিংকে সবুজে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সড়কের ডিভাইডার, ফ্লাইওভার, এমআরটির লাইন সবকিছুই সবুজ আর রঙিন ফুলে মোড়ানো।
তিনি বলেন, ২০০০ সালে হলিউডের বাইরে স্টার ওয়ারস তাদের দ্বিতীয় অফিস চালু করে সিঙ্গাপুরে। ২০১১ সালে চালু করে ফেসবুক। তাদের দৃষ্টিতে সিঙ্গাপুরে খুব সৃষ্টিশীল কিছু পাওয়া যাবে না, তবে সবুজে মোড়ানো শহর পাওয়া যাবে।
কোন ময়লাই ফেলা যায় না এখানে
২২ আগস্ট আমাদের যাত্রা ছিল পুলাউ সেলাকাউ দ্বীপে। তীর থেকে প্রায় ৩০ মিনিট স্পিডবোটের পথ। মনোরম দ্বীপ। এখানে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ম্যানগ্রোভ বন। এক কিলোমিটারেরও কম দীর্ঘ এই দ্বীপকে বড় করা হয়েছে বিভিন্ন শাখা প্রশাখায়। এখন প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন।
তবে এই দ্বীপটি কিন্তু আসলে ময়লার ভাগাড়। সিঙ্গাপুরে প্রতিদিন যত ময়লা জমা হয় সেগুলো কার্গোতে চাপিয়ে নিয়ে আসা হয় এখানে। এরপর বিভিন্ন ধাপে ভাগ করা হয়। এই ময়লা থেকে উৎপন্ন হয় বিদ্যুৎ। এমনকি প্লাস্টিক এবং লোহার দ্রব্যাদি আবারো ব্যবহারের জন্যে পাঠানো হয় কারখানায়।
এখানে কোন কিছুই ফেলা যায় না। এখানকার ব্যবস্থাপক হুয়েন ফান বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারের লক্ষ্য ৭০ শতাংশ বর্জ্যকে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করা।
এছাড়াও এই দ্বীপটি মাছ ধরার কাজেও ব্যবহৃত হয়। হুয়েন বলেন, আমি এখানে প্রতিদিনই আসি। তবে এখান থেকে মাছ কিনতে পারি না। কারণ এখানে দাম বেশী। ব্যবসায়ীরা বলেন, এখানকার মাছের স্বাদ আলাদা। তবে সত্যিকার অর্থে আমি বাজারের মাছের সঙ্গে কোন পার্থক্য পাই না।
মূত্রকে পানযোগ্য পানিতে রুপান্তর
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে যে চ্যালেঞ্জটি সিঙ্গাপুরের সামনে এসে দাঁড়ালো, সেটি হচ্ছে পানি। সমুদ্র ঘেরা এই দ্বীপের সরু খালের মতো নদীর পানি পানের উপযোগী নয়। আবার মাটির নিচেও সুপেয় পানির সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে উপায়!
উপায় বের করলেন গবেষকরা। যতোটা সম্ভব বৃষ্টির পানিকে সংরক্ষণ করা। সিঙ্গাপুরের ওপর যতোটা বৃষ্টি পড়ে সব পানিই সংরক্ষণ করা হয়। এখানে রাস্তা ধুয়ে যতো পানি জমা হয় সব পানিই আবার ব্যবহার উপযোগী করা হয়।
নিওয়াটার নামক প্রজেক্ট সকল পানিকে সংরক্ষণ করার কাজটি করে থাকে। মূলত ৪ টি মাধ্যম থেকে পানি পেয়ে থাকে সিঙ্গাপুর। মালয়েশিয়ার জোহর থেকে পানি আমদানি। ৯৯ বছরের জন্য করা এই চুক্তি শেষ হবে দুই হাজার একষট্টি সালে। দ্বিতীয় মাধ্যমটি হলো স্থানীয়রা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেন। তৃতীয় মাধ্যম হলো নিওয়াটারের পানি সংরক্ষণ এবং চতুর্থ মাধ্যম হলো-ব্যবহৃত পানিকে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করা।
এখানকার পরিচালক তিওম হু চেন বলেন, আমরা জনগণকে বলেছি, আমরা তোমাদের পানি দিচ্ছি, তোমরা আবার সেটি ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু কিভাবে! তোমরা মূত্র ত্যাগ করলেও সেটি আমাদের কাছে ফিরে আসবে। সে জন্যে যথাস্থানে মূত্র ত্যাগ করতে হবে।
তিনি বলেন, একটি সূক্ষ পদ্ধতিতে পানিকে পরিশোধণ করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। প্রথম দিকে এই পানি মানুষ খেতে চাইতো না। তবে প্রধানমন্ত্রী যখন ২০০৩ সালে একসঙ্গে ষাট হাজার মানুষকে নিয়ে এই পানি পান করলেন, মানুষের ভুল ভাঙ্গলো। এখন সবচেয়ে নিরাপদ পানি নিওয়াটা।
তিনি বলেন, পরিশোধিত পানি পাওয়ার পর অব্যবহার্য পানি সাগরে ফেলা হয়। যা আবারো বৃষ্টি হয়ে আমাদের কাছে আসে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৭
এমএন/জেডএম